স্থাপত্য-নিদর্শন
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঐতিহাসিক খনিয়াদিঘি মসজিদ
, ১৩ জুমাদাল উলা শরীফ, ১৪৪৫ হিজরী সন, ৩০ সাদিস ১৩৯১ শামসী সন , ২৮ নভেম্বর, ২০২৩ খ্রি:, ১২ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) স্থাপত্য নিদর্শন
ইটের তৈরি ঐতিহাসিক এ মসজিদে রয়েছে ৯ মিটার পার্শ্ববিশিষ্ট একটি বর্গাকৃতির নামায কক্ষ এবং পূর্বদিকে ৯ মি.দ্ধ৩ মি. মাপের একটি বারান্দা। নামায কক্ষের উপরের ছাদটি বিশাল গোলাকার গম্বুজ আকারে নির্মিত। অন্যদিকে বারান্দার উপরে আছে তিনটি ছোট গম্বুজ। নামায কক্ষের বিশাল গম্বুজটির কোণগুলিতে নির্মিত অর্ধগম্বুজাকৃতির আড়াআড়ি খিলান, চার প্রধান পার্শ্বের বদ্ধ খিলান ও খিলানগুলির মধ্যবর্তী পেন্ডেন্টিভ (ঢেউয়ের মতো ইউ আকৃতির খিলানের অংশ) এর উপর স্থাপিত। বারান্দার তিনটি ছোট গম্বুজ নির্মিত হয়েছে একই পদ্ধতিতে। বারান্দা থেকে নামায কক্ষে প্রবেশের জন্য তিনটি খিলানপথ রয়েছে। এগুলি উচ্চতা ও প্রশস্তে পূর্ব দিকস্থ একক খিলানপথগুলির অনুরূপ।
মসজিদের বাইরের চারকোণে রয়েছে চারটি অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ। এগুলি ছাদ পর্যন্ত উঁচু ছিল। আরও দুটি বুরুজ নামায কক্ষ ও বারান্দা যেখানে মিলিত হয়েছে সে স্থানকে চিহ্নিত করেছে। বুরুজগুলিকে উপরের দিকে উঠা ডিজাইন দ্বারা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
ক্বিবলা দেওয়াল ভেতরের দিক দিয়ে সম্পূর্ণরূপে গ্রানাইট পাথরের টুকরা দ্বারা আবৃত। এ দেওয়ালেই পূর্ব দিকের তিনটি খিলানপথের বরাবরে আছে অর্ধবৃত্তাকৃতির কুলুঙ্গিতে (জানালার মতো দেখতে দেয়ালের ছোট খোপ) তিনটি মিহরাব।
গম্বুজবহনকারী বদ্ধ খিলান ও স্কুইঞ্চগুলিকে (গম্বুজের ভর রক্ষা করার জন্য দেয়ালের কোনে নির্মাণ করা হয়) দেওয়ালগুলিতে দৃঢ়ভাবে নিহিত পাথরের স্তম্ভগুলির উপর স্থাপন করা হয়েছে। পূর্ব-পশ্চিমের খিলান দুটিও, যা বারান্দার অভ্যন্তরভাগকে তিন অংশে বিভক্ত করেছে, সংযুক্ত পাথরের স্তম্ভের উপর স্থাপিত। তিনটি মিহরাবের মধ্যে মাঝেরটি পার্শ্বস্থ দুটি মিহরাবের চেয়ে বড় এবং দেওয়ালের উচ্চতার পাশাপাশি বাইরের দিকে আয়তাকারে সামনের দিকে প্রলম্বিত। আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত এ মিহরাব কুলুঙ্গিগুলির প্রত্যেকটির মুখে খাঁজকাটা খিলান রয়েছে।
সম্পূর্ণ মসজিদ স্থাপনাটি এক সময় টেরাকোটা অলঙ্করণে শোভিত ছিল যার কিছু কিছু চিহ্ন ভেতরে ও বাইরে এখানে-সেখানে এখনও বিদ্যমান। ইমারতের চতুর্দিকে ছাঁচকৃত দুটি কার্নিশপট্টির মধ্যবর্তী স্থানসমূহে রয়েছে লতাপাতার নকশাসমৃদ্ধ ক্ষুদ্রাকৃতির খিলান সারি। চার দেওয়ালের সম্মুখভাগে আছে স্পষ্টভাবে সামনের দিকে প্রলম্বিত আয়তাকারের প্যানেলের দুটি সারি। এগুলি অনেকটা জানালার মতো দেখতে। এ ধরনের অলঙ্করণ কৌশল বাংলার সুলতানি আমলের মসজিদগুলি যেমন হযরত পান্ডুয়ার একলাখী মাজার স্থাপত্য (পনেরো শতক), জান্নাতবাদের তাঁতীপাড়া মসজিদ (১৪৮০ খৃ:) ও ছোট সোনা মসজিদ (১৪৯২-১৫১৯ খৃ:) এ অত্যন্ত লোকপ্রিয়ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।
ক্বিবলা দেওয়ালের অভ্যন্তরভাগে মূল অলঙ্করণের বেশির ভাগ এখনও অক্ষতভাবে সংরক্ষিত আছে।
মসজিদের নির্মাণ তারিখ কোনো শিলালিপি দ্বারা নির্ধারিত হয়নি। অবশ্য মধ্যবর্তী মিহরাবের উপরে একটি ‘এপিগ্রাফ’ আছে। এতে পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার আয়াত শরীফ উৎকীর্ণ করা আছে। কিন্তু স্থাপত্যিক রীতি বিচারে মনে হয় যে, এটি পরবর্তী ইলিয়াস শাহী আমলে ১৪৮০ খৃ: দিকে নির্মিত হয়েছে।
বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, এক গম্বুজ বিশিষ্ট নামায কক্ষ এবং পূর্বদিকে তিন গম্বুজ সম্বলিত বারান্দাসহ মসজিদটি উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে তৎকালীন বাংলায় প্রচলিত একগম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদের চেয়ে ভাবগাম্ভীর্যপূর্র্ণ ছিল।
মুসলিম বিশ্বের স্থাপত্যিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সেলজুক ও উসমানীয় সালতানাতের শাসনাধীনে তুরস্কের আনাতোলিয়ায় নির্মিত এক ধরনের জনপ্রিয় মসজিদ রীতির সাথে খনিয়াদিঘির মসজিদের মিল আছে। মনে হয়, এ দূরবর্তী অঞ্চল থেকে সেলজুক শিল্পী ও কারিগরগণের মাধ্যমে মসজিদ স্থাপত্যের এ রীতির প্রভাব বাংলায় এসে পড়েছিল।
(সূত্র: ইসলামিক হেরিটেজ অব বেঙ্গল, মেমোরিজ অব পান্ডুয়া-আবিদ আলী, বাংলাপিডিয়া।)
-মুহম্মদ নাঈম।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কায়রোর ঐতিহাসিক আল আযহার জামে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় (পর্ব ০১)
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
৪০০ বছরের আলোচিত প্রাচীন স্থাপত্য তেবাড়িয়া জামে মসজিদ
১২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (২)
০৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
জাপানের টোকিও জামে মসজিদ
০৫ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (১)
৩১ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া শাহী মসজিদ
২৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
মেথি ভেজানো পানি পানের নানা উপকারিতা জেনে নিন
২৬ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
শেরপুরে তুরকান হযরত শাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাজার শরীফ
২২ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
ইউরোপের যত মুসলিম স্থাপত্য
১৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
লালমনিরহাটের ১৪শ বছর আগের ঐতিহাসিক ‘হারানো মসজিদ’ (১)
১৫ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
মুসলিম স্থাপত্য শৈলীর অন্যতম আল্লাহর মসজিদ
১১ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
খেজুরের পাতায় লিখা পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ
০৬ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার)