ইতিহাস
ঐতিহাসিক হেজাজ রেলওয়ে” যে রেলপথকে বলা হয় ‘বিশ্বের সব মুসলমানের সম্পত্তি’
, ১৮ ই জুমাদাল ঊলা শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ২৪ সাদিস, ১৩৯২ শামসী সন , ২১ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রি:, ০৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) ইতিহাস
যদি কোনো সম্পদকে সারাবিশ্বের মুসলমানদের সম্পত্তি বলা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা নিয়ে কৌতুহল অবশ্যই বৃদ্ধি পায়। জানার আকাঙ্খা তৈরী হয়। এরকম একটি সম্পদ হলো ঐতিহাসিক হেজাজ রেলওয়ে। যে রেলওয়ের সাথে জড়িয়ে আছে মুসলমানদের আবেগ, মুহব্বত এবং ত্যাগ।
পূর্বে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র হজ্জ করার জন্য দূর দূরান্ত থেকে মানুষকে নানা অপ্রচলিত বাহন, উটে সাওয়ার কিংবা জাহাজে করে পৌঁছাতে হতো। ফলে পবিত্র মক্কা শরীফ পৌঁছতে লেগে যেতো কয়েক সপ্তাহ। অনেক ক্ষেত্রে মাসও পার হয়ে যেতো। সিরিয়ার দামেস্ক থেকে পবিত্র মক্কা শরীফ পৌঁছাতে অন্তত ৪০ দিন সময় লাগতো। সফরকালে শুষ্ক মরুভূমি, পাহাড়ি দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক হজ্জযাত্রী ইন্তেকাল করতেন।
আর এই কষ্টটি লাঘব করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন উসমানীয় সালতানাতের সর্বশেষ যোগ্য সুলতান আব্দুল হামিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি। এই রেলপথ নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো, পবিত্র মদীনা শরীফ উনার সাথে রেলপথে সংযোগ স্থাপন করা এবং মুসলিম ভূখন্ডগুলোকে একই সুঁতোও বাধানো। কারণ সে সময় উসমানীয় সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত তিউনিসিয়া দখল করেছিলো ফ্রান্স, ব্রিটিশরা আগ্রাসন চালিয়েছিলো মিশরে। রোমানিয়া ও সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রোও উসমানীয় সালতানাত থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো। তাই সুলতান চেয়েছিলেন এই রেলপথের মাধ্যমে মুসলিম সালতানাতকে আবারও একত্রিত করতে।
এজন্য ১৯০০ সালের ১ সেপ্টেম্বর সুলতান আব্দুল হামিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ১৩২০ কি.মি এই রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। প্রকল্পটির নাম দেয়া হয় ‘হেজাজ রেলওয়ে’। পরবর্তীতে ১৯০৮ এ রেললাইনের নির্মাণকাজ শেষ হয়। হেজাজ রেলওয়ে লাইনের দামেস্ক থেকে পবিত্র মদীনা শরীফ অংশের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর এই রেললাইনকে উসমানীয় সালতানাতের রাজধানী বর্তমান ইস্তাম্বুলের সাথে সংযোগের কাজ শুরু হয়। এভাবেই এই রেলপথ উত্তর ইস্তাম্বুল থেকে দক্ষিনে পবিত্র মক্কা শরীফ পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করে।
এই রেলপথের সাথে মিশে আছে সারাবিশ্বের মুসলমানদের অপরিসীম আবেগ এবং মুহব্বত। কারণ এই রেলপথ নির্মাণ শুরু হওয়ার পর এ খবর যখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তখন এই রেলপথের পুরো অর্থ এসেছিলো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানদের অনুদান থেকে। উসমানীয় সালতানাতের মুসলমানদের প্রদত্ত অর্থ থেকে। এই রেলপথে অর্থ দেয়ার জন্য ভারতবর্ষের মুসলমান নারীরা নিজেদের গহনা বিক্রি করে তা উসমানীয়দের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। আর এই কারণেই আজও এই রেলপথটি বিবেচিত হয় বিশ্বের সব মুসলমানের অধিকার হিসেবে।
এমনকি রেললাইন নেয়ার জন্য যে সব মুসলমানদের জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছিলো উনাদের জন্য উসমানীয় সালতানাতের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকার পরও উনারা এক পয়সাও নিতে রাজী হননি। যে সব উসমানীয় সৈন্য (আরব ও তুর্কি মিলিয়ে) এই প্রকল্পে কাজ করেছেন উনারা কেউই এই কাজের জন্য কোনো ভাতা নেন নি।
এই প্রকল্প যেহেতু মুসলিম উম্মাহর কল্যানের জন্য করা হচ্ছিলো, এজন্য এই প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ব্যক্তিই অত্যন্ত উৎসাহ ও মুহব্বতের সাথে কাজ করেছিলেন। ফলে প্রতি বছর উনারা ২৮৮ কি:মি রেল ট্রাক বসাতে পেরেছেন। অথচ, সে সময় ইউরোপীয় রেলওয়ে বিশেষজ্ঞরা ঘোষণা দিয়েছিলো যে, যত কিছুই করা হোক না কেন বছরে ১০০ কি:মি এর বেশি ট্রাক বসানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
তবে এই রেলপথ চালুর পরের বছরই ইহুদীবাদী ষড়যন্ত্র ও মুসলিম নামধারী মুনাফিকদের কারসাজিতে ক্ষমতাচ্যুত হন সুলতান আব্দুল হামিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি। উনাকে নির্বাসনে দেয়া হয়। এরপর এই রেলপথের উন্নয়ন কাজও থেমে যায়। পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উসমানীয় সেনাবাহিনী এই রেলপথ ব্যবহার শুরু করে। যা দেখে তৎকালীন কুখ্যাত ছদ্মবেশী ব্রিটিশ গোয়েন্দা টিই লরেন্স গাদ্দার আরব মুনাফিক গোত্রদের সাথে নিয়ে এই রেলপথে হামলা চালিয়ে রেলপথটির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। যে ক্ষতির দাগ আজো রয়ে গেছে। বর্তমানে এই রেলপথটি ৫টি দেশের অংশ হয়ে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন। দেশগুলো হলো, তুরস্ক, সিরিয়া, জর্ডান, জাজিরাতুল আরব (সৌদি) ও ফিলিস্তিন।
ঐতিহাসিক এই রেলপথটি বর্তমানে সক্রিয় না থাকলেও মৃত হয়নি রেলপথটিকে ঘিরে মুসলমানদের আবেগ। এখনো মুসলমানরা প্রত্যাশা করেন যে, এই রেলপথটি চালু হবে এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্বের পুরনো অনুভূতি আবারও ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ!
-মুহম্মদ শাহ জালাল।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
সম্মানিত খিলাফত মুবারক উনার সময়কার একটি ঈমানদীপ্ত ঘটনা
২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে ভারতীয় লুটেরা সেনাবাহিনীর নজীরবিহীন লুটপাটের ইতিহাস
১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার ইতিহাসে স্বর্ণ পরিশোধন ও রফতানি
১২ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
দিল্লির সুলতান হযরত শামসুদ্দীন আলতামাশ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার গুনাহমুক্ত জীবন
০৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
তাতার বিরোধী যুদ্ধে হযরত আমীর খসরু দেহলভী চিশতী রহমতুল্লাহি আলাইহি
০৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
আজকের নগরসভ্যতার জনক মুসলমানগণই
০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
আফগানিস্তানেও উগ্রতাবাদী ওহাবী-সালাফীদের অনুপ্রবেশের অপচেষ্টা
২৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
মুসলমানগণই আধুনিক কাগজ শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা
১৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
ইতিহাস চর্চা ও সংরক্ষণে মুসলমানদের অবদান
১০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি
০৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
মুসলিম সোনালী যুগের পাঠাগার
০৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
আগলাবী সালতানাতের মুসলিম নৌবহর (১)
৩১ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার)