সূর্যমুখী সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে কেন?
, ১৯ শাওওয়াল শরীফ, ১৪৪৪ হিজরী সন, ১০ ছানী ‘আশির, ১৩৯০ শামসী সন , ১০ মে, ২০২৩ খ্রি:, ২৭ বৈশাখ, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) পাঁচ মিশালী
প্রতিদিন ভোরে সূর্যমুখী বাগানের সকল গাছ অনেকটা প্যারেড দলের মতো পূর্বদিকে মুখ করে থাকে। যে দিকে সূর্য দেখা যায় এবং ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। সূর্যের সাথে সাথে সূর্যমুখীগুলোও ধীরে ধীরে নিজেদের দিক পাল্টাতে থাকে। সূর্য যেদিকে যায় তারাও সেদিকে যায়। সবসময়ই এগুলো সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। সূর্য যখন পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তারাও তখন পশ্চিমদিক বরাবর থাকে। অস্ত যাবার পরে তারা সারারাত ব্যাপী আবার উলটো দিকে ঘুরে পূর্বমুখী হয়। নতুন একটা দিনে আবার সূর্যের মুখোমুখি হয়। এভাবে চক্রাকারে চলতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত তাদের এই চক্র চলতেই থাকে।
সূর্যমুখীর এই প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছিল। কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের একটি দল সূর্যমুখীর এই দিক পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের রহস্য উন্মোচন করেছে। তাদের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে সূর্যমুখীরা তাদের নিজস্ব সার্কাডিয়ান চক্রে আবদ্ধ। এই চক্র সচল থাকার কারণে সূর্যমুখীরা সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। গবেষকরা সায়েন্স জার্নালে তাদের গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করেছে।
সার্কাডিয়ান চক্র বা সার্কাডিয়ান ঘড়িকে অনেক সময় ‘দেহ ঘড়ি’ নামেও ডাকা হয়। মানুষের মাঝেও এই চক্র বিদ্যমান। যেমন প্রত্যেক মানুষেরই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম চলে আসে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। কোনো একজন লোকের সবসময় রাত ১১টায় ঘুমিয়ে অভ্যাস। একদিন তার অজান্তে ঘড়ি নষ্ট হয়ে গেল। দুই ঘণ্টা পিছিয়ে পড়লো ঘড়ির কাটা। এমতাবস্থায় ৯ টায়-ই ঘুম ধরবে ঐ লোকের। যান্ত্রিক ঘড়ির সময় যাই হোক, দেহের নিজস্ব ঘড়ি ঠিকই উপযুক্ত সময়ে ঘুমের কথা জানান দিয়ে দিবে। এই আভ্যন্তরীণ ঘড়ি বা চক্রই হচ্ছে সার্কাডিয়ান চক্র।
সূর্যমুখীর কা- দিনের বেলা সূর্যকে অনুসরণ করে এবং রাতের বেলা বিপরীতমুখী হয়ে আবার সূর্যের জন্য অপেক্ষা করে।
উদ্ভিদের মাঝে সাধারণত এই চক্রের উপস্থিতি থাকে না। খুব অল্প সংখ্যক ব্যতিক্রমের মাঝে একটি হচ্ছে সূর্যমুখী। এই চক্রকে ব্যবহার করে সূর্যমুখী ফুল সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। সূর্যের দিকে মুখ করে থাকলে ফুল আকারে বড় হয় এবং পরাগায়নের জন্য মৌমাছিকে আকৃষ্ট করতে সাহায্য করে। এই বৈশিষ্ট্য সূর্যমুখীকে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। যে ফুল আকৃতিতে বড় হবে এবং পরাগায়নের জন্য অধিক পরিমাণ মৌমাছি পাবে সেই ফুলের বীজ হওয়া তথা টিকে থাকার সম্ভাবনা অবশ্যই বেশি।
সূর্যমুখীদের এই বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। প্রথমে তারা গাছকে কাঠির সাথে আটকে রাখে যেন নড়াচড়া করতে না পারে। পাশাপাশি গাছ যে সময় পূর্বদিকে মুখ করে থাকার কথা ঐ সময় জোর করে গাছকে পশ্চিমমুখী করে দেয়া হয়। এতে দেখা যায় গাছেরা এই পরিবর্তনকে কাটিয়ে উঠতে পারে। আবার চক্রে ফিরে যেতে পারে।
তারপর তারা ফুল গাছগুলোকে ঘরের ছায়ায় নিয়ে আসে। এখানে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কোনো বিরতি ছাড়াই কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করে। সূর্যমুখীর কাছে সূর্যের বিরামহীন অবস্থা উপস্থাপন করা হয়। এতেও দেখা যায় গাছেরা আগের মতোই চক্রাকার দোলায় দুলছে। গবেষকরাও এদের কাছে এমন আচরণই আশা করছিলো।
এরপর তারা কৃত্রিমভাবে দিন-রাতের চক্রের সৃষ্টি করলো। পূর্ব দিক থেকে আলোকের উদয় হয় এবং নিয়ম মেনেই ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। এই চক্র যখন সূর্যের চক্রের অনুরূপ ছিল অর্থাৎ প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার করে চক্র সম্পন্ন হয় তখন পর্যন্ত সূর্যমুখীরা তাল মিলিয়ে চলতে পেরেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা চক্রের মাঝে কিছু পরিবর্তন আনে। ২৪ ঘণ্টার বদলে চক্র নিয়ে যায় ৩০ ঘণ্টায়। যখন থেকে চক্র পালটে ৩০ ঘন্টায় চলে গেল তখন থেকে সূর্যমুখীদের মানিয়ে নিতে সমস্যা হতে লাগলো। তাদের আভ্যন্তরীণ সার্কাডিয়ান ঘড়িতে বিঘœ ঘটতে লাগলো।
একইসাথে সূর্যকে অনুসরণ করা এবং আভ্যন্তরীণ ঘড়ি মিলিয়ে চলা সম্ভব হয়ে উঠে না এদের বেলায়। তাই ৩০ ঘণ্টার চক্রে এরা তালগোল পাকিয়ে ফেলে। হয় ২৪ ঘণ্টার চক্রে সূর্যের আলো দাও নয় সারাদিনই দাও, এতে সমস্যা নেই, গাছেরা মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু বিভ্রান্তিমূলকভাবে ৩০ ঘণ্টা বা তার থেকে বেশি সময় ব্যাপী চক্র উপস্থাপন করলে তাতে খাপ খাইয়ে নিতে সমস্যা হবে।
মানুষের বেলাতেও এরকম হয়। কেউ যদি রাতের বেলায় সবসময় লাইট জ্বালিয়ে রাখে তাহলে তার চক্র ২৪ ঘণ্টায় সম্পন্ন না হয়ে ধীরে ধীরে ২৫ ঘণ্টায় আবর্তিত হয়। আজ ১১ টায় ঘুমালে আগামীকাল ১২ টায় ঘুমাবে। পরের দিন ১ টায়। এরকম করে এগোবে।
তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, চক্র হোক আর যাই হোক, ঠিক কোন কার্যপ্রণালীর উপস্থিতির কারণে গাছের এমন পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়? গবেষকরা দেখতে পায় এর পেছনে দায়ী আছে সূর্যমুখীর এক পেশে বৃদ্ধি। একপেশে বলতে বোঝানো হচ্ছে গাছের কা-ের এক দিক অন্য দিকের চেয়ে বেশি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। দিনের বেলা কা-ের পূর্ব পাশে তুলনামূলকভাবে বেশি বিভাজন হয়, ফলে বেশি বৃদ্ধি হয়। দুই দিকে একটা তারতম্যের সৃষ্টি হয় এবং এতে করে কা- পূর্বদিক থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিমমুখী হয়। সন্ধ্যার পর থেকে আবার এই চক্র উল্টোভাবে সম্পন্ন হয়। কা-ের পশ্চিম পাশের অংশ পূর্বপাশের তুলনায় বেশি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ফলে ধীরে ধীরে কা- পূর্বমুখী হয়ে যায়। ভোর হবার আগেই এই চক্র সম্পন্ন হয়ে যায় এবং সূর্য উঠার সাথে সাথে নতুন আরেকটি চক্রের শুরু হয়।
এই চক্রের উপস্থিতির কারণে এরা কিছুটা সুবিধা পায়। গবেষকরা দেখেছে যে সকল ফুলদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখা হয় বা চক্রে বিঘœ সৃষ্টি করা হয় তারা স্বাভাবিকের চেয়ে শতকরা ১০ ভাগ ছোট হয়ে থাকে।
সূর্যের দিকে মুখ করে থাকার ফলে শুধু সূর্যমুখীই না, উল্লেখ করার মতো প্রায় সকল উদ্ভিদই সূর্যের দিকে মুখ করে থাকতে চায়। হয়তো সূর্যমুখীর মতো প্রতিদিন দিক পাল্টায় না কিন্তু সবসময়ই সূর্যের দিকে মুখ করে থাকতে চায়। উদ্ভিদের এই বৈশিষ্ট্যকে বলে আলোকমুখীতা বা ঐবষরড়ঃৎড়ঢ়রংস। টবে গাছ লাগিয়ে ঘরে রেখে দিলে দেখা যাবে গাছগুলো জানালামুখী হচ্ছে। যেদিকে সূর্যের আলো আসে সেদিক দিয়ে বাড়তে চায় গাছগুলো। উদ্ভিদ সূর্যের আলোর মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পানি ব্যবহার করে নিজেদের খাদ্য তৈরি করে।
তবে অন্যান্য উদ্ভিদগুলোতে সার্কাডিয়ান চক্র না থাকাতে সূর্যমুখীর মতো এরা দিন-রাতে নিজেদের অবস্থান পাল্টাতে পারে না।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
মঙ্গলে বিস্ময়কর ‘সবুজ দাগের’ সন্ধান!
০২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
আইসল্যান্ডে আগ্নেয়গিরির গর্ভে বিজ্ঞানীদের নজর
০২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
পরোক্ষ ধূমপান স্বাস্থ্যগত দিক থেকে যে সমস্ত মারাত্মক ক্ষতি করে?
০১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
মুসলমানদের বসবাস বা দ্বীন ইসলাম প্রচার নিষিদ্ধ করে রেখেছে যে সমস্ত বিধর্মী রাষ্ট্র
০১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
২০২২ সালে সৌরজগতের বাইরে মিলেছে ২০০ গ্রহের সন্ধান
৩১ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
মুসলিম দেশ সিয়েরা লিওনে যেভাবে দ্বীন ইসলাম ও দ্বীনি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়
৩১ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
আবাসন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপিয়ানরা
৩১ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
হেঁটে যে রাস্তা আজও শেষ করতে পারেনি কেউ
২৯ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
লাওসে মুসলমানদের জীবনধারা
২৯ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
কাতারের মরুভূমিতে খোদাই করা রহস্যময় শত শত চিহ্ন
২৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
রহস্যময় পুরুষ ইলিশ! কেন তেমন দেখা মেলে না (২)
২৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
রহস্যময় পুরুষ ইলিশ! কেন তেমন দেখা মেলে না (১)
২৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার)