ইতিহাস পাঠ: পবিত্র মসজিদের উপর উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের ধারাবাহিকতা
, ১৪ রমাদ্বান শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ১৬ আশির, ১৩৯২ শামসী সন , ১৫ মার্চ, ২০২৫ খ্রি:, ২৮ ফালগুন, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) ইতিহাস

ব্রিটিশ আমল শুরুর পর যখন থেকে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অবসান হয়েছে, তখন থেকেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে বহু ঐতিহাসিক মসজিদ ও মাযার শরীফ ধ্বংস করেছে। সেসবের প্রতিবাদ হয়নি বলেই কাল্পনিক ‘রামমন্দির’-এর দোহাই দিয়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছে এবং তাজমহলের জায়গায় মন্দির থাকার বানোয়াট ও মিথ্যা দাবি করেছে জাতিগতভাবে জালিয়াত ও সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা। যেমন-
১৩৭৩ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহী বংশের অন্তর্গত বাংলার স্বাধীন সুলতানী আমলের অন্যতম শাসক সুলতান সিকান্দার শাহ নির্মাণ করেন আদিনা মসজিদ। এই মসজিদটি তৎকালীন সময়ে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদ ছিল।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় অবস্থিত এই মসজিদে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে হামলা চালিয়েছিল উগ্র সাঁওতালেরা। তৎকালীন সময়ে নীচুবর্ণের হিন্দুরা মসজিদসমূহে হামলার মাধ্যমে তাদের নিজেদেরকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করতে অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিল। এ প্রসঙ্গে জয়া চ্যাটার্জি রচিত ‘বাঙলা ভাগ হলো: হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশ বিভাগ’ গ্রন্থের ২৩২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে-
“ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে নিম্ন শ্রেণীর লোকদের মূলধারার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আনার এসব আন্দোলন তাদেরকে বাহ্যিকভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রতি আরো বেশি করে আকৃষ্ট করে। জিতু সাঁওতালের সর্বশেষ আক্রমণটি হয় ঐতিহাসিক আদিনা মসজিদকে ঘিরে, ১৯৩২ সালে। জিতু ও তার অনুসারী একদল সাঁওতাল লোক এই মসজিদে আক্রমণ চালায় এবং ধ্বংসাশেষের উপর ‘অশাস্ত্রসম্মতভাবে’ কালী উপাসনার ব্যবস্থা করে। এ সময় পুলিশের গুলিতে জিতু নিহত হয়। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুদেরকে হিন্দু রাজনীতিতে আনার প্রয়াস যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে অনেক আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের ঘটনা ঘটে। ”
জিতু সান্যালের নেতৃত্বে আদিনা মসজিদ দখল করে সেখানে কালীপূজা করার কথা বর্ণিত রয়েছে ইতিহাসে, ঠিক সেভাবেই ভারতের প্রত্যেকটি দাঙ্গাতেই মুসলমানদের মসজিদ ভেঙে সেখানে মন্দির তৈরি করা হয় এবং রীতিমতো পূজা-অর্চনা শুরু করে দেয়া হয়। গুজরাট দাঙ্গায় গুজরাটের বিভিন্ন ঐতিহাসিক মসজিদ, মাদরাসা ও মাযার শরীফসমূহ ধ্বংস করা ও সেগুলোতে মন্দির তৈরি করা প্রসঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসবিদ গোলাম আহমদ মোর্তজা তার রচিত ‘ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়’ গ্রন্থের ৬১-৬২ পৃষ্ঠাতে উল্লেখ করেছেন-
“মুসলমানদের ধনসম্পত্তি এবং নারী-শিশুদের শুধু প্রাণনাশ করার উদ্দেশ্য ছিল একথা মেনে নেয়া যায় না। কেননা তাদের মসজিদ-মাদরাসা ও দরগাহগুলো নিশ্চয়ই ঘাতকদের রুটি-রুজিতে হাত দেয়নি, তবুও সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে। মসজিদগুলো নামায পড়া ছাড়া আর কোনো কাজেই লাগান না মুসলমানরা। তবুও রেহাই পেলো না সেগুলো। ভাঙা হয়েছে ডা-িয়াবাজারের রাওপুরার মীর বাকার আলী মসজিদ। ভাঙা হয়েছে সালাতওয়াদা মসজিদ, ছিপওয়াদের হাজী হামজা মসজিদ। সেইসঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো নাভাবাজারের বেগম সাহেবার মসজিদ। কারেলীবাগ রোডে তাজগিরা কবরস্থানে অবস্থিত মদিনা মসজিদও ভাঙা হয়েছে। বারানপুরা মসজিদের দশাও হয় একই। প্রতাপনগরের ওভারব্রিজের নিচের মসজিদটিও ধ্বংস করেছে উগ্র রামভক্তের দল। তারসালি মসজিদ, মাকারপুরা মসজিদ এবং কিসানওয়াদির একটি মসজিদও ধুলিসাৎ করা হয়েছে ধর্মীয় উল্লাসে। ছানি রোডে মাদ্রাসা ও তৎসংলগ্ন মসজিদটিও আক্রান্ত হলো। এইভাবে চল্লিশটি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। এই চল্লিশটি ছাড়াও ভাঙা হয়েছে আরো অনেক মসজিদ।
অতীব দুঃখ ও ক্ষোভের কথা এই যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মসজিদ ভাঙার পর উহার অভ্যন্তরে বসানো হয়েছে হনুমান দেবতার মূর্তি। আর বেশ কয়েকটিতে শুরু করা হয়েছিল পূজা-অর্চনা ও আরতি। পীর-বুযূর্গ ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের কবর ও মাযার শরীফগুলোকেও রেহাই দেয়নি উগ্র রামভক্তেরা। মসজিদ ও মাযার শরীফসমূহের কতগুলো ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে তার উপর পিচঢালা রাস্তা এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে নবাগত কেউ ভাবতেই পারবেন না যে- ঐ স্থানে একদিন ছিল স্থাপত্য শিল্পের ঐতিহাসিক কোনো নিদর্শন। ”
-মুহম্মদ গোলাম মুর্শিদ।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
মোগল সেনাপতির ডায়েরী প্রকাশ ও বিধর্মীদের প্রচারিত মিথ্যা ইতিহাস ফাঁস
১৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলিম কর্তৃক অমুসলিম-বিধর্মীদের ক্ষমতায়িত করার করুণ পরিণতি
১৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ইতিহাস পুনঃপাঠ: দাঙ্গায় হিন্দু পুলিশের ভূমিকা
১৪ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
শুধু স্পেন কিংবা বাগদাদ থেকে নয়, ভারতবর্ষ থেকেও মুসলমানদের লাইব্রেরীর কিতাবাদি লুট করেছিল ব্রিটিশরা
১৩ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (১৩)
০৭ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
শের আলী খান আফ্রিদী: ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া একজন মুসলিম বীর
০৩ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (১২)
০১ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মহাপবিত্র সুন্নত মুবারক হিসেবে ‘কুস্তি’ লড়াইকে যেভাবে ধরে রেখেছিলো উসমানীয়রা
২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার খিলাফতকালের একটি ঘটনা
২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
ইংল্যান্ড কত সম্পদ এ অঞ্চল থেকে লুট করেছিলো?
১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
কাফির-মুশরিকদের আসল চরিত্র
১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
শাসক আকবরের যে আমল কখনো কোনভাবেই নষ্ট হয়নি এবং হয় না
১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার)