ঘটনা থেকে শিক্ষা
ছদক্বাহ করার ফলে বিপদের সময় উটনীর দুধ লাভ
, ১৯ মুহররমুল হারাম শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ২৮ ছানী, ১৩৯২ শামসী সন , ২৬ জুলাই, ২০২৪ খ্রি:, ১১ শ্রাবণ, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) পবিত্র দ্বীন শিক্ষা
একটি সত্য ঘটনা:
ঘটনাটি ঘটে প্রায় এক’শ বছর আগে সৌদি আরবের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ঘটনাটি তৎকালীন মিডিয়াতেও প্রচার করা হয়। ঘটনাটা ইব্নু জাদআন নামক এক ব্যক্তির। তার ছিল অনেকগুলো মোটা-তাজা উট। এই উটগুলোর ওলান এতই পূর্ণ ছিল যে, দেখে মনে হতো ভারে ফেটে যাবে।
ইব্নু জাদআন নিজের কথায় বর্ণনা করেন যে, আমার পাশেই দরিদ্র এক প্রতিবেশী ছিল। সেই প্রতিবেশীর ছিল সাতটি কন্যা সন্তান। আমি আমার উটের পালের একটা উটনী বাচ্চাসহ তাকে ছদক্বাহ হিসেবে দিয়ে দেওয়ার জন্য মনস্থির করলাম। আমি তখন এই আয়াত শরীফটি আবৃত্তি করলাম যেখানে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ
অর্থ: “যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের পছন্দের জিনিস থেকে খরচ করবে, ততক্ষণ তোমরা পুণ্য অর্জন করতে পারবে না। ” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ-৯২)
আমার উটের পালের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে উটনীগুলো। আমি আমার উটের পাল থেকে ভালো একটি উটনী তার বাচ্চাসহ নিয়ে গেলাম আমার প্রতিবেশীর কাছে। তাকে বললাম, “আমার পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে এটা গ্রহণ করুন। ” এটা শুনে আনন্দে তার চোখ-মুখ যেন জ্বলজ্বল করে উঠল। কি বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না।
উটনীর দুধ থেকে আমার প্রতিবেশী ভালোই উপকার পাচ্ছিল। সে ওটার পিঠে কাঠ বহন করাত। ওটার বাচ্চাটা বড় হওয়ার জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল, যাতে সেটা ভালো দামে বিক্রি করতে পারে। এভাবে অনেক কল্যাণই সে পেতে লাগল।
বসন্তের পরে শুষ্ক গ্রীষ্ম তার অনাবৃষ্টি নিয়ে হাজির হলো। পানি ও ঘাসের খোঁজে আমি বেরিয়ে পড়লাম। পানির জন্য আমি দুহূলের খোঁজ করতে লাগলাম। দুহূল হচ্ছে এমন এক গর্তের মুখ যেটা ভূগর্ভস্থ পানির সন্ধান দিতে পারে। এসব গর্তের মুখগুলো মাটির উপরেই থাকে। আমরা আরব বেদুইনরা এগুলো ভালোভাবেই চিনতে পারি।
পানি নিয়ে আসার জন্য আমি এ রকম এক গর্তের মধ্যে প্রবেশ করলাম...
ইব্নু জাদআনের তিন ছেলে গর্তের বাইরে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তাদের বাবা ফিরে আসছিল না। তারা একদিন, দু’দিন, তিনদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করল। কিন্তু তখনো তার বাবার ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই। আশাহত হয়ে পড়ল তারা। তারা ভাবল তাদের বাবাকে হয়তো সাপে কেটেছে, কিংবা গর্তের ভেতরে হারিয়ে গেছে। তারা তাদের বাবার মৃত্যুর প্রহর গুনছিল। যাতে তারা ইব্নু জাদআনের উত্তরাধিকার সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতে পারে।
তারা বাড়ি ফিরে এল। নিজেদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করে নিল। তাদের হঠাৎ মনে পড়ল, তাদের বাবা পাশের এক প্রতিবেশীকে একটা উটনী দান করেছিলেন। তারা সেই প্রতিবেশীর কাছে গিয়ে বলল, ভালোয় ভালোয় সে যেন সেই উটনী দিয়ে দেয় এবং এর পরিবর্তে অন্য একটা উটনী নেয়। না হলে তারা জোর করে সেই উটনীটি নিয়ে নেবে। তখন আর তার কাছে কিছুই থাকবে না।
প্রতিবেশী তখন বলল, সে তাদের বাবাকে এই কথা জানাবে। ছেলেরা বলল, তাদের বাবা মারা গেছে। প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করল কিভাবে এবং কোথায় ইব্নু জাদআন মারা গেছে। তাকে এখনো জানায়নি কেন। ছেলেরা তখন তাকে বলল যে, তাদের বাবা মরুভূমির একটা গর্তে প্রবেশ করেছিল পানি আনার জন্য; কিন্তু আর ফিরে আসেনি।
প্রতিবেশী বলল, “মহান আল্লাহ পাক উনার কসম! তোমরা আমাকে সেই জায়গায় নিয়ে যাও, আর তোমাদের উটনীও নিয়ে নাও। এটা দিয়ে যা খুশি করো, আমি আর তোমাদের উটনী চাই না। ”
ছেলেরা তাকে সেই গর্তের প্রবেশমুখে নিয়ে গেল। সে একটা দড়ি আনল এবং আলো জ্বালাল। দড়িটা সে গর্তের বাইরে বাঁধল। এরপর হামাগুড়ি দিয়ে গর্তের মধ্যে প্রবেশ করল। যেতে যেতে এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছালো, যেখানে সে কোনোমতে গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে পারে। অবশেষে এক পর্যায়ে সে ভেজা মাটির গন্ধ পেল। তখন হঠাৎ সে শুনতে পেল পানির ধারে কোনো একজনের গোঙানির শব্দ।
শব্দ শুনে শুনে সে উৎসের কাছে যেতে লাগল, খুঁজতে লাগল চারপাশে হাত বিছিয়ে। এবং একসময় হাতড়ে হাতড়ে কাউকে যেন খুঁজে পেল। লোকটার দম আছে কি না দেখল। অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করল যে, এক সপ্তাহ পরেও সেই লোকের এখনো দম আছে। তাকে বের করে নিয়ে এল। সে তার সাথে কিছু খেজুর নিয়ে গিয়েছিল। এগুলো পানিতে ভিজিয়ে খেতে দিল লোকটিকে। সেই লোকটি আর কেউ নয়; ইব্নু জাদআন!
বেদুইন প্রতিবেশী তাকে পিঠে করে বয়ে তার বাসায় নিয়ে এলো। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল ইব্নু জাদআন। তার ছেলেরা জানতেও পারল না। প্রতিবেশী তখন ইব্নু জাদআনকে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে এক সপ্তাহ আপনি বেঁচে ছিলেন?”
ইব্নু জাদআন বলা শুরু করলেন, “সে এক আজব ঘটনা। নিচে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না। যেখানে পৌঁছেছিলাম সেখানে পানি ছিল। ভাবলাম, এই পানির কাছাকাছিই থাকি।
কাজেই পানি খেয়ে দিন পার করতে লাগলাম। কিন্তু ক্ষুধা না মানে অন্য কিছু। পানি খেয়ে আর পারছিলাম না। তিন দিন পর ক্ষুধা আরও তীব্রতর হলো। চারপাশ থেকে যেন চেপে ধরল ক্ষুধা। শুয়ে শুয়ে নিজেকে মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে সঁপে দিলাম।
এরপর হঠাৎ টের পেলাম আমার মুখের উপর গরম দুধ ঝরছে। আমি অন্ধকারের মাঝে উঠে বসলাম। দেখলাম একটা পাত্র আসছে আমার কাছে। পাত্রটা থেকে দুধ খাওয়া শুরু করলাম। যতক্ষণ না খেয়ে পেট ভরছে, ততক্ষণ খেতাম। এরপর এটা চলে যেত। দিনে তিনবার এমনটা হতো। কিন্তু শেষ দু’দিন আর এমনটা হয়নি। জানি না কেন এমন হলো। ”
তার প্রতিবেশী তখন তাকে জানাল, “এর কারণ জানলে আপনি আরও বেশি আশ্চর্যান্বিত হবেন। আপনার ছেলেরা ভেবেছিল আপনি মারা গেছেন। তারা আমার কাছে এসে আপনি আমায় যে উটনী দিয়েছিলেন সেটা নিয়ে যায়। সম্ভবত মহান আল্লাহ পাক তিনি এই উটের দুধই আপনাকে খাওয়াচ্ছিলেন। ”
ছদক্বাহ এভাবেই একজন মুসলিমকে বিপদে ছায়া দিয়ে রাখে। মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
অর্থ: “আর যে মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করে তিনি তার জন্য (সংকট থেকে) বের হওয়ার একটা পথ করেই দিবেন। আর তাকে এমন জায়গা থেকে রিযিকের ব্যবস্থা করবেন, যা সে ধারণাও করে না। যে মহান আল্লাহ পাক উনার উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। ” (পবিত্র সূরা তলাক্ব শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ- ২-৩)
-০-
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
“আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম” কিতাবের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিরোধিতাকারীদের আপত্তির জবাব
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
পর্দা রক্ষা করা ফরজ, বেপর্দা হওয়া ব্যভিচারের সমতুল্য
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৪)
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
সারাবিশ্বে একই দিনে ঈদ পালন ও রোযা শুরু করার কথা বলার উদ্দেশ্য পবিত্র ঈদ ও পবিত্র রোযাকে নষ্ট করা, যা মূলত মুনাফিকদের একটি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত (৬৩)
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে হালাল ও হারাম উভয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে (১২)
২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ছবি তোলা হারাম ও নাজায়িজ
২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ শরীয়তসম্মত, নিখুঁত, ব্যবহারে সহজ এবং রহমত, বরকত, সাকীনা লাভের কারণ (৫)
২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
সম্মানিত মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু কাফির-মুশরিকরা
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
পর্দা করা ফরজ, বেপর্দা হওয়া হারাম
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার)