হাজার বছরের গন্তব্য ওয়াদি আস সালাম (১)
, ০৩ রবীউছ ছানী শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ০৯ খ্বমিস , ১৩৯২ শামসী সন , ০৭ অক্টোবর , ২০২৪ খ্রি:, ২২ আশ্বিন, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) পাঁচ মিশালী
ওপর থেকে দেখলে মনে হয় জনবহুল নগরী। ইটের স্থাপনা যেন পাশাপাশি লেগে থাকা ঘর। কিন্তু একটু সময় গেলেই ভেঙে যায় ভুল। স্থাপনাগুলো ঘর না, কবর। জায়গাটা নগরী বটে, তবে মরদেহের। লাখো মানুষের স্মৃতিচিহ্ন জিইয়ে রাখা নগরী। ইরাকের নাজাফে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গোরস্তান ওয়াদি আস সালাম। কত শাসক, রাজপুত্র, ইমাম, সম্ভ্রান্ত বণিক আর দাপুটে বিজ্ঞানী এখানে শায়িত, তার হিসাব নেই। প্রায় দেড় হাজার বছরে সেখানে ঠাঁই নিয়েছে ৫০ লাখের বেশি মানুষ।
মৃতের গন্তব্য হিসেবে নাজাফে জায়গা করে নেয়ার ইতিহাস পুরনো। সাসানীয় ও পার্থিয়ান আমল থেকেই মরদেহ কবর দেয়া হতো নাজাফে।
অনেকে মনে করে, প্রথম দিকের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের কবরও এখানে বিদ্যমান। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের শহরগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কবরস্থান। হিরা ও কুফায়ও বেশকিছু গোরস্তান এখনো টিকে রয়েছে নানাভাবে। ওয়াদি আস সালামের ইতিহাস তাই স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট দীর্ঘ। স্বাভাবিকভাবেই গোরস্তানটি ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
নাজাফ যতগুলো কারণে গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে অন্যতম হলো- খোলাফায়ে রাশেদীন উনাদের মধ্যে চতুর্থ খলিফা হযরত ইমামুল আউওয়াল আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনার রওজা শরীফও সেখানে। শিয়া ও সুন্নি উভয়ের কাছেই তিনি সম্মানিত চরিত্র, ফলে নাজাফেরও রয়েছে বাড়তি মর্যাদা।
অনেকেই বলে থাকেন, সেখানে কবর হলে পরবর্তী জীবনে মুক্তির জন্য রাস্তা সহজ হবে। এদিক থেকে শিয়া বিশ্বাসীদের মধ্যে বেশকিছু হাদীছ শরীফও প্রচলিত। হাদীছ শরীফ অনুসারে- হযরত ইমামুল আউওয়াল কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম তিনি পরকালীন জীবনের জন্য একজন স্বীকৃত মধ্যস্থতাকারী। মৃত্যুর পরে কবরের শাস্তি কমানো, বিচার দিবসকে সহজ করে দেয়া এবং মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী সময়কে সংক্ষিপ্ত করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারেন তিনি। এটা উনার বিশেষ খুছূছিয়ত।
এর সূত্র ধরেই ইতিহাসের বিভিন্ন সময় বিপুলসংখ্যক মানুষ চেয়েছে তাদের কবর হোক ওয়াদি আস সালামে। অর্থাৎ উনার রওজা মুবারকের আশপাশে।
এছাড়া শিয়াদের বিশ্বাস অনুসারে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার আওলাদ হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম উনাকে সঙ্গে নিয়ে একবার ইরাকের নাজাফে এসেছিলেন। সেখানে তিনি নিজের নামে এক টুকরো জমি ক্রয় করেন। সে জমির টুকরোটিই ওয়াদি আস সালাম কবরস্থান। বিভিন্ন সময়ে এ গোরস্তানের ফযীলতও বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে মানুষ আকাঙ্খা করেছে নাজাফের মাটিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে। ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে এর ভূমিকা ছিল সুদূরপ্রসারী।
বিশ শতকেই প্রতি বছর ২০ হাজার মরদেহ আনা হতো নাজাফে কবর দেয়ার জন্য। তাদের বড় অংশই আসত ইরান থেকে। কিছু অংশ আসত ভারত ও উসমানি সালতানাত থেকে। বর্তমানে প্রতি বছর এক লাখ মরদেহ নাজাফে কবরস্থ হয়। মরদেহের প্রধান অংশ আসে ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, লেবানন, সৌদি আরব, ও ইয়েমেন থেকে। যেহেতু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই মানুষ মৃত্যুর পরে নাজাফ যেতে চেয়েছে, ফলে মরদেহ পরিবহন করে নাজাফে নিয়ে যাওয়া একটা চর্চায় পরিণত হয় ইতিহাসে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নাজাফে মরদেহ নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ব্যবসাও। সেটা এতটাই প্রবল ছিল যে বাধ্য হয়ে সে সময় পরিবহনকারীদের ওপর মরদেহ সংরক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে ফতওয়া জারি করতে হয়। পাশাপাশি পরিবহন ব্যয় ও শুল্কও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, যেন অরাজকতা তৈরি না হয়। বর্তমান সময়েও ওয়াদি আস সালামে মরদেহের জায়গা বরাদ্দ, মিনার নির্মাণ, কবর খনন, মরদেহকে গোসল করানোর পর কবরস্থ করার জন্য প্রস্তুতকরণ, সমাধির রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চলে।
ওয়াদি আস সালামকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বহুমাত্রিক বিশেষ পরিষেবা। পরিবহন, খাবার ও পানীয় সরবরাহ ও দ্বীনি কার্যক্রমকে ঘিরে দিনকে দিন বেড়েছে আর্থিক লেনদেনও। ফলে মরদেহ কবরস্থ করাকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজনেরও দীর্ঘ ঐতিহাসিক সিলসিলা বিদ্যমান ইতিহাসে।
হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনার রওজা মুবারকের সামনের চত্বরে একসময় কবর দেয়া হতো রাজপুত্র, সুলতান ও তাদের স্ত্রীদের। তবে ১৭৯১ সালে বড় ধরনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে সেগুলোকে নতুন রূপ দেয়া হয়েছে। পরে আরো কয়েক দফা হয়েছে সংস্কার। নাজাফ থেকে কুফার পথ ধরে বেশ কয়েকটি কবরস্থান ছিল একসময়। বিংশ শতাব্দীর দিকে পার্কিং লট, পার্ক, সরকারি ভবন ও বেসরকারি আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য বেশকিছু কবর সরিয়ে ফেলা হয়। বিভিন্ন সময়ে সংস্কার ও পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে বদলেছে চেহারা। নাজাফের কবর বলতে এখন কেবল ওয়াদি আস সালাম গোরস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে ৩০ বছরে গোরস্তানটির আকার বেড়েছে কয়েক গুণ। ১৯৭৩ সালে গোরস্তানের আকার ছিল ১৯৬ হেক্টর, ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে এক হাজার হেক্টরে। আকারের এ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ছিল ইরাক যুদ্ধ ও আইএস উগ্র গোষ্ঠীর উত্থান।
ওয়াদি আস সালাম গোরস্তানের আকৃতি আয়তাকার। নিচু কংক্রিটের দেয়াল ও কয়েকটি গেট রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্বে বিবর্ধিত। পুরো অংশটাকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত পুরনো গোরস্তান। উত্তর-পূর্বে অবস্থিত নতুন গোরস্তান। এখানে শায়িত মানুষের সংখ্যা ৬০ লাখ বলে ধরে নেয়া হয়। আয়তন বিবেচনায় হোক কিংবা কবরের সংখ্যা বিবেচনায়; এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম গোরস্তান। পৃথিবীর নানা প্রান্তের, নানা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের মানুষ এখানে শায়িত। অতিকায় এ গোরস্তানের মধ্যে কবরে যাওয়া-আসার জন্য ৪২টি সড়ক রয়েছে। সেগুলোর অধিকাংশ দিয়েই থ্রি হুইলার চলাচল করতে পারে। শহর থেকে থ্রি হুইলারগুলো পর্যটকদের গোরস্তানের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত প্রত্যাশিত কবরের কাছে নিয়ে যেতে পারে। কবর জিয়ারতকারীদের জন্য সুবিধা হয় বিষয়টি।
গোরস্তানের পুরনো অংশে কবরগুলো একেকটা ইউনিট আকারে তৈরি হয়েছে। সেখানে যথেষ্ট পরিকল্পনার অভাব পরিদৃষ্ট হয়। কবরস্থ করার প্রক্রিয়াও ছিল সে সময়ে প্রাচীন প্রক্রিয়ায়। তবে নতুন গোরস্তানে অনেক কিছুই করা হয়েছে পরিকল্পনামাফিক। দুই পাশের সমাধিকে বিভক্ত করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বংশ, পরিবার ও গোষ্ঠী এবং শহর অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে। অধিকাংশ কবরস্থানের ক্ষেত্রেই এ নীতি মান্য করা হয়। মানুষ চায় মৃত্যুর পর তাদের প্রিয় মানুষ, আত্মীয় কিংবা ভৌগোলিক বৃত্তের মধ্যে কবরস্থ হতে। আবার কবর খুঁজে পাওয়ার সুবিধার জন্যও এটা করা হয়। বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা নির্দিষ্ট পরিবারের সদস্যদেরও উদ্দেশ্য থাকে পারিবারিক পূর্বপুরুষদের সঙ্গে শায়িত হওয়ার বা কোনো বিশেষ গ্রামের সঙ্গে শায়িত হওয়ার জন্য। ভারতীয়, লেবাননীয়, উপসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য গোরস্তানে বলতে গেলে অনেকটা পৃথক ইউনিট রয়েছে।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
সূর্যের দিকে সবচেয়ে কাছের যাত্রায় মহাকাশযান
২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
১৮০০ বছর পর তুরস্কের প্রাচীন কেস্ট্রোস ফোয়ারা চালু
২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
দিনে তিন কাপ কফি মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি করতে সক্ষম - ক্যানসার-হার্টের মত আত্মঘাতী রোগ-ব্যাধি দূর করে
২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম প্রজাতন্ত্রের দেশ সেনেগাল
১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
সেনেগালে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম ও ইসলামী আদর্শে নতুন মাত্রা
১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
ঘরোয়া ঔষধ হিসেবে আদা
১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
রাশিয়ার আকাশে দেখা মিললো উজ্জ্বল গ্রহাণুর
১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
মসজিদের ভেতরে ৫৪০ বছরের পুরনো জিনের মসজিদ!
১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
চাঁদের বয়স কত? এক খ- পাথরের মাধ্যমে যা জানা গেল
১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
পাখির অভয়াশ্রম যে গ্রাম
১২ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
বায়ুদূষণ কতোটা ক্ষতিকর, জানালো গবেষণা
১২ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
প্রতিদিন ডাল খেলে যে ৩টি দারুণ উপকার মিলবে
১২ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার)