ক্বাদিরিয়া সিলসিলার আউলিয়ায়ে কিরাম উনাদের জীবনী মুবারক
হযরত শায়েখ আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি (১)
বিলাদত শরীফ: ২৪৭ হিজরী (৮৫১ খ্রিস্টাব্দ) বিছাল শরীফ: ৩৩৪ হিজরী (৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) বয়স মুবারক: ৮৭ বছর
, ১৯ রমাদ্বান শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ২১ আশির, ১৩৯২ শামসী সন , ২০ মার্চ, ২০২৫ খ্রি:, ৫ চৈত্র, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) ইলমে তাছাউফ

পরিচিতি:
উনার আসল নাম জা’ফর বিন ইউনুস, যদিও কেউ কেউ অন্যান্য নামও বলেছেন। কারণ বাগদাদে উনার মাযার শরীফের উপর যে শিলালিপি রয়েছে তাতে জা’ফর বিন ইউনুসই লিখা রয়েছে। (নাফাহাতুল উন্স)
তবে তিনি উনার কুনিয়াত বা উপনাম “আবূ বকর শিবলী” দ্বারা মশহুর। তিনি তৃতীয় তবকার আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের মধ্যে একজন। তিনি বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন। হযরত খাজা খায়ের নাসসাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার হাতে তিনি তওবা করেন, কিন্তু হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুরীদ ছিলেন। তিনি একজন বিশিষ্ট আরিফ ছিলেন এবং মজলিসে ওয়াজ নছীহত করতেন। তিনি হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।
নাফাহাতুল উন্স কিতাবে তাবাকাতে সালমা কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, উনার পিতৃপুরুষ খুরাসানের অধিবাসী ছিলেন এবং বাগদাদে লালিত পালিত হন। ছফিনাতুল আওলিয়া কিতাবে উলেখ আছে, উনার পিতৃপুরুষ খুরাসানের অন্তর্গত শিবলিয়া গ্রামে বসবাস করতেন।
সিয়ারু আ’লামিন নুবালা কিতাবেও বলা হয়েছে, সমরকন্দের নিকটবর্তী শিবলিয়া গ্রামে তিনি বিলাদত শরীফ গ্রহণ করেন, সে জন্য শিবলী নামে পরিচিত। পরে তিনি বাগদাদে লালিত পালিত হন এবং বসবাস করেন। (মিরাতুল আসরার)
প্রাথমিক অবস্থা এবং জীবনের মোড় পরিবর্তন:
উনার প্রাথমিক অবস্থার ঘটনা এইরূপ বর্ণিত আছে যে, তিনি নেহাওয়ান্দের আমীর (গভর্ণর) ছিলেন। একবার বাগদাদের খলীফা প্রত্যেক প্রদেশের গভর্ণরকে বাগদাদে আসার জন্য পত্র দ্বারা নির্দেশ দেন। পত্র পাওয়া মাত্র সকল গভর্ণর এবং তিনিও বাগদাদে এসে পৌঁছেন। খলীফা সকলকে উপঢৌকন (খালয়াত) প্রদান করে বিদায় করলেন। জনৈক গভর্ণরের সম্ভবত: হাঁচি এসেছিলো। সে খলীফার দরবার থেকে প্রাপ্ত উপঢৌকন দ্বারা মুখ ও নাক পরিষ্কার করলো। কোন কুচক্রী এসে এই খবর খলীফাকে জানালে খলীফা আদেশ করলেন, এর উপঢৌকন ফেরত রেখে দাও এবং তাকে গভর্ণরের পদ থেকে বরখাস্ত করে দাও। তৎক্ষণাৎ খলীফার আদেশ পালন করা হলো। হযরত শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইহা দেখে চমকে উঠলেন এবং চিন্তা করলেন যে, মানুষের প্রদত্ত উপঢৌকনের অবমাননা করার ফলে সরকারের পক্ষ হতে উপঢৌকন ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং পদচ্যূত করা হয়, অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হয়। তবে যে ব্যক্তি সারাবিশ্বের বাদশাহ খ¦ালিক্ব, মালিক, রব, মহান আল্লাহ পাক উনার উপঢৌকনের অবমাননা করবে তার কি অবস্থা হবে? এরূপ কল্পনা করে তিনি তৎক্ষণাৎ খলীফার দরবারে গিয়ে বললেন, ‘আপনি একজন সৃষ্ট মানুষ হয়ে আপনার প্রদত্ত উপঢৌকনের সাথে বেয়াদবী করা পছন্দ করেন না। অথচ সারাবিশ্বের বাদশাহ মহান আল্লাহ পাক উনার উপঢৌকনের সম্মুখে আপনার উপঢৌকন কিছুই নয়। অতএব মহান আল্লাহ পাক তিনি যখন আমাকে নিজের মা’রিফাত এবং বন্ধুত্বের উপঢৌকন দান করেছেন, তখন তিনি ইহা কখনও পছন্দ করবেন না যে, একজন মানুষের সেবায় থেকে সেই উপঢৌকনকে কলুষিত করি,’ এই বলে তিনি খলীফার দরবার থেকে বের হয়ে আসলেন।
মুর্শিদের মাধ্যমে তা’লীম ও তরবিয়ত:
অতঃপর প্রথমে হযরত আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হযরত খায়ের নাসসাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দরবারে গিয়ে তওবা করেন। তিনি উনাকে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রমতুল্লাহি আলাইহি উনার খিদমতে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললেন, লোকে আপনার নিকট রতেœর সন্ধান বলে দিয়েছে। আপনি সেই রতœ এমনিই দান করুন, অথবা মূল্য গ্রহণ পূর্বক বিক্রয় করুন।
হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, “আমি বিক্রয় করলে তুমি উহা খরিদ করতে পারবে না। কেননা, এত মূল্য তোমার নিকট নেই। আর যদি বিনামূল্যে দান করি, তবে তুমি এর কদর বুঝতে পারবে না। কেননা, বিনামূল্যে প্রাপ্ত রতেœর প্রতি অমর্যাদা দেখিয়ে বরবাদ করে ফেলবে। তবে হ্যা সাহসী তরীকতপন্থীর ন্যায় মস্তক দ্বারা কদম বানাও এবং নিজেকে এই দরিয়ায় নিক্ষেপ করো, যাতে ধৈর্য্য ও প্রতীক্ষার পর সেই রতœ লাভ করতে পারো। ” অতঃপর হযরত আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি আরজ করলেন, আমাকে বলে দিন, এখন আমি কি করবো? হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, যাও; এক বৎসর পর্যন্ত মূর্তি বিক্রয় করতে থাকো। শায়েখের আদেশে হযরত আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি পূর্ণ এক বৎসর কাল আদেশ পালন করে বৎসর শেষে আবার উনার খিদমতে হাজির হলেন। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনাকে এবার বললেন, যাও; এক বৎসর পর্যন্ত মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে থাকো। কিন্তু এমনভাবে করবে যে, কোন কিছুতেই জড়িয়ে পড়বে না। তিনি তাই করলেন, পূর্ণ এক বৎসর ধরে বাগদাদের প্রত্যেকটি বাজারে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করলেন। কিন্তু কেউই উনাকে কিছু দিলো না। বৎসর শেষে তিনি হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট ফিরে এসে এ সমস্ত ঘটনা ও অবস্থা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলেন।
ঘটনা শুনে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, এখন তুমি বুঝতে পারলে যে, মানুষের নিকট তোমার কোন মূল্য ও মর্যাদা নেই। সুতরাং কখনও এসবের মধ্যে মন লাগিও না। অতঃপর বললেন, যেহেতু তুমি নেহাওয়ান্দের গভর্ণর ছিলে, সুতরাং সেখানে গিয়ে তুমি সমস্ত লোকের নিকট মাফ চাও। তিনি নেহাওয়ান্দে গেলেন এবং সমস্ত শহরে ঘুরে প্রত্যেকটি ঘরে গমনপূর্বক ছোট বড় সকলের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কেবলমাত্র একজন লোক শহরে উপস্থিত না থাকায় উনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারলেন না। তিনি তার পরিবর্তে এক লক্ষ দিরহাম ছদকা হিসাবে দান করলেন। এতেও উনার তৃপ্তি হলো না। সর্বদা পেরেশান রইলেন। এই পেরেশানীর মধ্যে চার বৎসর কাল অতীত হয়ে গেলে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, এখনও তোমার মধ্যে কিছু পরিমাণ মান মর্যাদার অভিলাষ বাকী রয়েছে। যাও; আবার এক বৎসর ভিক্ষা করো। অতঃপর তিনি আরো এক বৎসর পর্যন্ত ভিক্ষাবৃত্তি করতে থাকলেন। সারাদিন ভিক্ষা করে যা কিছু পেতেন, হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট নিয়ে আসতেন। তিনি তা দরবেশদের মধ্যে বন্টন করে দিতেন এবং উনাকে ক্ষুধার্ত রাখতেন। এভাবে এক বৎসর পূর্ণ হয়ে গেলে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, এখন তোমাকে আমি আমার ছোহবতে রাখতে পারি। কিন্তু এ শর্তে যে, ছূফিদের খেদমত করতে হবে। অতঃপর তিনি হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ছোহবত মুবারকে থেকে পূর্ণ এক বৎসর ছূফি-দরবেশদের খেদমত করলেন। অতঃপর হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবূ বকর! এখন তোমার নফ্সের মর্যাদা তোমার নিকট কতখানি? তিনি আরজ করলেন, হযরত! আমি নিজকে দুনিয়ার সমস্ত মানুসের চেয়ে অধম বলে মনে করি। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, এখন তোমার ঈমান ঠিক হয়েছে। (তাজকিরাতুল আওলিয়া) (অসমাপ্ত)
-আল্লামা সাঈদ আহমদ গজনবী।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
মুহলিকাত তথা বদ স্বভাবসমূহ
০৭ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
পবিত্র মুনজিয়াত উনার বিবরণ
০৫ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ওলীআল্লাহ উনাদের ছোহবতে যাওয়া ব্যতীত কারো পক্ষে প্রকৃত মু’মিন-মুসলমান হওয়া সম্ভব নয়
০৫ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাওয়ানেহ উমরী মুবারক (১২)
০৪ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
হযরত শায়েখ আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি (৬)
২৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
হযরত শায়েখ আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি (৫)
২৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
হযরত শায়েখ আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি (৪)
২৩ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
হযরত শায়েখ আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি (২)
২১ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৩৬)
০৮ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৩৫)
০৭ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৩৪)
০৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৩৩)
২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার)