স্থাপত্যের এক অন্যতম নিদর্শন সিরাজগঞ্জের ঐতিহাসিক নবগ্রাম এক গম্বুজ মসজিদ
, ১৬ শাওওয়াল শরীফ, ১৪৪৪ হিজরী সন, ০৭ ছানী ‘আশির, ১৩৯০ শামসী সন , ০৭ মে, ২০২৩ খ্রি:, ২৪ বৈশাখ, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) স্থাপত্য নিদর্শন
দৈনিক আল-ইহসানের এক অনুসন্ধানে জানা গেছে মূলত বাজার মনিটরিংয়ের অভাবে ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বাজারে পর্যাপ্ত ভোজ্যতেলের মজুত থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। বিশ্ববাজারে দাম কত, আমদানিতে খরচ হলো কত, সরবরাহ চেইনে বিক্রি হচ্ছে কত টাকায়, মজুত থাকলে কী পরিমাণ রয়েছে, পণ্যটিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার রয়েছে কিনা এসব জিনিস মনিটরিং করা উচিত।
বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে প্রধানত দায়ী করা হয় সিন্ডিকেট মহলকে। এই সিন্ডিকেট গং দেশের প্রতিটি দ্রব্যের খাত কব্জা করে রেখেছে। চিনি, চাল, তেল, লবণ এমন কোনো খাত নেই যেখানে এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম নেই। আর এই দৌরাত্ম এক দুই বছর নয় বরং কয়েক যুগ ধরে চলে আসছে। কিন্তু কোনো সরকারই ক্ষমতায় এসে এই সিন্ডিকেটদের নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না। তাদের লাগাম টেনে ধরছে না। বর্তমান সরকারেরও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বস্তুত বাজার নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে সরকারের শক্ত কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। দুর্বল বাজার মনিটরিং, অসৎ আমদানিকারক, উৎপাদক, পরিবেশক, সরবরাহকারী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী, অকার্যকর টিসিবি, সর্বোপরি ট্যারিফ কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে আদৌ কোন সমন্বয় না থাকাও দ্রব্যমূল্যের দামবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। যে কারণে ভোক্তা ক্রেতাস্বার্থ অধিকার এবং সংরক্ষণ বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। দিনের পর দিন মূল্যবৃদ্ধির চক্রে পড়ে আর্থিকভাবে দৈন্য হয়ে যাচ্ছে জনগণ।
প্রসঙ্গত, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে কথাবার্তা উঠলেই পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পরস্পরকে দোষারোপ করে থাকে। এভাবে একপক্ষ অপরপক্ষকে দোষারোপ করলেও এটি মূলত ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রনের প্রয়াস, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন আবার দেশের কথিত কর্তাব্যক্তিরাও দ্রব্যমূল্য নিয়ে দায়সারা বক্তব্য প্রদান করছে।
আমরা মনে করি, নানা অপকৌশলে ভোক্তাদের ঠকানো ছাড়াও কারসাজি ও যোগসাজসের মাধ্যমে যখন তখন নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া রাষ্ট্রীয় আইনে বিশেষ অপরাধ তো বটেই সে সাথে মহা অনৈসলামিক তথা হক্কুল ইবাদ নষ্টের মতো কঠিন হারামও। আর রাষ্ট্র যদি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন করতে না পারে তাহলে সেটাও হক্কুল ইবাদ নষ্টের অন্তুর্ভূক্ত হবে। আর এর দায়বদ্ধতাও অনেক বড়।
সঙ্গতকারণেই আমরা মনে করি, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির খড়গ থেকে জনগণকে মুক্ত করা সরকারের বর্তমান প্রধান ও অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। সরকারের উচিত হবে, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দায় থেকে সরে না এসে কিভাবে উপযুক্ত মনিটরিং এবং শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য জনগণের নাগালের মধ্যে রাখা যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে দেশ থেকে প্রতিবছর দুর্নীতির মাধ্যমে যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয় তা রোধ করে সেই অর্থ বাজার ব্যবস্থাপনা ও পণ্যের ভর্তুকিতে প্রদান করা। বিশেষ করে, পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে খাতভিত্তিক যেসকল সিন্ডিকেট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রেখেছে তারা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সার্বিক কারণগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করে সে অনুযায়ী ধাপভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আর এ সবকিছুই সরকারকে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার অনুভূতি থেকেই করতে হবে। হক্কুল ইবাদ নষ্টের আশঙ্কা থেকে সতর্ক হয়ে।
চলনবিলের প্রাণকেদ্র সিরাজগঞ্জে তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের নওগাঁ গ্রামের ঐতিহাসিক শাহী মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্বের নিদর্শন স্বরূপ আজো দাঁড়িয়ে আছে। নবগ্রাম এক গম্বুজ মসজিদটি সিরাজগঞ্জ জেলার (আগের পাবনা জেলা) তাড়াশ উপজেলা সদরের ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত মুঘল যুগের একটি সুদৃশ্য মসজিদ। তাড়াশ উপজেলা সদর থেকে মহিষলুটি পর্যন্ত বাসে গিয়ে সেখান থেকে নওগাঁ মাজার পর্যন্ত ইঞ্জিনচালিত দেশীয় যান (টলারে) যাওয়া যায়। চাটমোহর রেলস্টেশন থেকে প্রায় ২০.৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে মসজিদটির অবস্থান।
নবগ্রাম এলাকা স্থানীয়ভাবে নওগাঁ নামে পরিচিত। ১৯৩৭ খৃ: এর অল্প কিছুকাল আগে এক আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের এক ব্যক্তি নবগ্রাম গ্রামের একটি মসজিদে কালো পাথরে আরবি তুগরা লিপিতে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দেখতে পান। সে এই ছাপচিত্র গ্রহণ করে ভারতের শিলালিপি বিশেষজ্ঞ শামসুদ্দীন আহমদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। শামসুদ্দীন আহমদ সেটির পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনা করেন ১৯৩৭-৩৮ খৃ: এপিগ্রাফিয়া ইন্দো-মোসলেমিকাতে প্রকাশ করেন। লিপিটিতে উল্লিখিত নির্মাতার নাম পরবর্তী সময়ে আবদুল করিম সঠিকভাবে পাঠোদ্ধার করেছেন। যেহেতু শিলালিপিটি তার মূল অবস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি মসজিদের অভ্যন্তরে পাওয়া গেছে এবং নিকটবর্তী কয়েক মাইলের মধ্যে অন্য কোনো প্রাচীন মসজিদের অস্তিত্ব নেই সেহেতু এটিকে সুলতানি আমলে নির্মিত উক্ত মসজিদের লিপি বলে ধরে নেওয়া হয়। শিলালিপি অনুসারে সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের পুত্র সুলতান নাসিরউদ্দীন আবুল মুজাফফর নুসরত শাহের সা¤্রাজ্যকালে ৯৩২ হিজরী ৪ রজবুল হারাম/১৫২৬ খৃ: ২১ এপ্রিল মসজিদটি নির্মিত হয়। লক্ষণীয়, লিপিটিতে মসজিদের নির্মাতাকে ‘মীর বহর মনোয়ার আনার (বা মুনুরাণা) পুত্র আজিয়াল মিয়া জংদার’ (যোদ্ধা) হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঐতিহাসিক এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটির পূর্বদিকে একটি বারান্দা আছে। পূর্বে এ মসজিদের শিলালিপিটি সংযুক্ত ছিল। বর্তমানে রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা সংরক্ষণাগারে রক্ষিত (এক্সেশন নং ১৫২৩) এ শিলালিপি অনুযায়ী মসজিদটি মির বহর (নৌ অধ্যক্ষ) মানাওয়ার আনা (মুনারানা)-এর পুত্র আজিয়াল মিনা জংদার কর্তৃক ১৬২৬ খৃ: নির্মিত হয়।
এ এলাকার পূর্ববর্তী নাম সিমলাবাদ। সুলতানি আমলে এটি একটি খিত্তা বা প্রাকারবেষ্টিত শহর ছিল। শিলালিপিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ আছে : ‘জংদার’, ‘মির বহর’ ও ‘নাজির’। মসজিদ সংলগ্ন মাজার শরীফের জন্য এলাকাটি বিখ্যাত। সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহের সময় থেকে সুলতান নাসির উদ্দীন নুসরত শাহের সময়কাল পর্যন্ত এই এলাকা একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। এ মসজিদের কাছে ভাগ্নের মসজিদ নামে পনেরো গম্বুজের আরেকটি মসজিদের অবশিষ্টাংশ আছে।
মসজিদটি পূর্ব এবং উত্তর দিকে বর্ধিত করা হয়েছে। নামাজ কক্ষের পূর্ব দিকে তিনটি প্রবেশ-পথ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে প্রবেশ-পথ আছে। বারান্দার পূর্বদিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে প্রবেশ-পথ আছে। এ মসজিদের বর্হিবাগে ছয়টি বুরুজ সংযুক্ত আছে।
ইট-নির্মিত এক গম্বুজের এ বর্গাকার মসজিদের প্রতি বাহুর অভ্যন্তরীণ পরিমাপ ৭.২ মিটার। এর চারকোণে রয়েছে অষ্টকোণাকার চারটি পার্শ্ববুরুজ। ছাঁঁচ ঢালা আলঙ্করিক নকশার ব্যান্ড (ইধহফ) দিয়ে বুরুজগুলিকে তিন অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। মসজিদের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে রয়েছে একটি করে খিলানকৃত প্রবেশপথ। গৌড়ের নগরদুর্গের গুমতি গেট এবং লট্টন মসজিদ এর সঙ্গে পরিকল্পনা ও অলঙ্করণের বিবেচনায় এর তুলনা করা যেতে পারে। মসজিদে নকশাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো ঝুলন্ত শিকল-ঘণ্টার মোটিফ। সুলতানি স্থাপত্যরীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মসজিদের সছিদ্র প্রাচীর ও কার্নিস সামান্য বক্রাকার, এবং এরই ওপরে বসানো আছে অর্ধগোলাকার গম্বুজ।
অভ্যন্তরীণভাবে এ মসজিদের নামাজ-কক্ষটি ৭.৩১ মি. বর্গাকার। কিবলা দেওয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। মধ্যবর্তী মিহরাবটি বৃহত্তর। মসজিদের অভ্যন্তরে চার দেওয়ালের প্রতিটিতে দুটি করে অর্ধ-স্তম্ভ সংযুক্ত রয়েছে। এ মসজিদের চার দেওয়ালের উপরের দিকে বক্র-ছাদ কিনারা দেখা যায়।
কোন কোন ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, ১৯৫০ খৃ: এই ঐতিহাসিক মসজিদটি মেরামত করা হয়। আবার কোন লেখক উল্লেখ করেছেন যে, এটি ১৩৫৪-৫৫ ফসলী সনে অর্থাৎ ১৯৪৭-৪৮ খৃ: মেরামত করা হয়। তবে উভয়ের বর্ণিত তারিখই নিকটবর্তী।
তথ্যসূত্র: Inscriptions of Bengal, Vol. IV, Rajshahi, 1960; AH Dani, Muslim Architecture in Bengal, Dhaka , 1961; Syed Mahmudul Hassan, Muslim Monuments of Bangladesh, Dhaka , 1971, and internet.
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কায়রোর ঐতিহাসিক আল আযহার জামে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় (পর্ব ০৭)
২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
হাজীগঞ্জ দুর্গ
১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
কায়রোর ঐতিহাসিক আল আযহার জামে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় (পর্ব ০৬)
১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
সুনামগঞ্জে কালের সাক্ষী শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী পাগলা বড় মসজিদ
১২ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
৫০০ বছরের ঐতিহাসিক নিদর্শন বাঘা শাহী মসজিদ
০৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৬)
০৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
কায়রোর ঐতিহাসিক আল আযহার জামে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় (পর্ব ০৫)
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
কায়রোর ঐতিহাসিক আল আযহার জামে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় (পর্ব ০৪)
০২ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
কায়রোর ঐতিহাসিক আল আযহার জামে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় (পর্ব ০৩)
২৬ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
কায়রোর ঐতিহাসিক আল আযহার জামে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় (পর্ব ০২)
২৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
কায়রোর ঐতিহাসিক আল আযহার জামে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় (পর্ব ০১)
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
৪০০ বছরের আলোচিত প্রাচীন স্থাপত্য তেবাড়িয়া জামে মসজিদ
১২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার)