সম্মানিত যাকাত উনার আহকাম, মাসায়িল ও ফাযায়িল (৮)
, ২৯ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০:০০ এএম ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) পবিত্র দ্বীন শিক্ষা
পাওনাদারের সম্মানিত যাকাত আদায়ের বিধান :
নিছাব পরিমাণ মাল অর্থাৎ ৫২.৫ তোলা রৌপ্য অথবা ৭.৫ তোলা স্বর্ণ অথবা তার সমমূল্যের টাকা যদি কোন ব্যক্তির নিকট এক বছর পূর্ণ মালিকানাধীন থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। তখন উক্ত ছাহেবে নিছাবকে তার টাকার শতকরা আড়াই টাকা যাকাত দেয়া ফরয।
আর যাকাত আদায়ের জন্যে শর্ত হচ্ছে যাকাতের মাল গরীব-মিসকীন বা দরিদ্রকে মালিক করে দেয়া। কিন্তু মালিক না করে যদি যাকাতের নিয়তে খেতে দেয়া হয়, তাতে যাকাত আদায় হবে না। কেননা তা মালিক করে দেয়া হয়নি শুধুমাত্র তা খেতে দেয়া হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ কোন পাওনাদার যদি তার ফরয যাকাত আদায়ের সময় এই নিয়ত করে যে, আমি ওমুক ব্যক্তির নিকট ৫০ হাজার টাকা পাওনা আছি সেখান থেকে তাকে যাকাত বাবদ মাফ করে দিলাম। এতে যাকাত কস্মিনকালেও আদায় হবে না।
দেনাদারের কাছে যে টাক বাকী বা পাওনা আছে সেই টাকা যাকাত বাবদ কেটে দিলে যাকাত আদায় হবে না। তবে যে সকল দেনাদার দরিদ্র অর্থাৎ যাকাতের হক্বদার, তার কাছে যাকাতদাতা পাওনাদার। যাকাতের মাল থেকে যেই পরিমাণ টাকা পাওনা আছে সেই পরিমাণ টাকা তাকে মালিক করে দিয়ে বলবে যে, এ টাকা তুমি পাওনা বাবদ আমাকে ফিরিয়ে দাও। যেমন- কোন মালিকে নিছাব ব্যবসায়ীর কাছে কোন খরিদদার ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। এখন উক্ত ব্যবসায়ী তার মালের যাকাত থেকে ১০ হাজার টাকা খরিদদারকে মালিক করে দিয়ে বলবে, আমি তোমার কাছে যেই ১০ হাজার টাকা পাওনা ছিলাম তা তুমি এ টাকা দ্বারা পরিশোধ করে দাও। এতে খরিদদারও দেনা থেকে মুক্তি পেল আর ব্যবসায়ীর যাকাতও আদায় হল এবং তার পাওনা টাকাও সে বুঝে পেল।
আর দেনাদার যদি দরিদ্র না হয়, তাকে যাকাতের মালিক করে দিলে যাকাত আদায় হবেনা। এতে যাকাত দাতা ও গ্রহিতা উভয়ে গোনাহ্গার হয়ে যাবে। এ অবস্থায় যাকাতদাতাকে তার সঞ্চিত টাকা থেকেই যাকাতের টাকা অন্য দরিদ্রকে মালিক করার মাধ্যমে আদায় করতে হবে। আর যে টাকা দেনাদারের কাছে পাওনা আছে সেই পাওনা টাকা বা যে মাল কর্জ হিসাবে দেয়া হয়েছে, তার যাকাত কখন ফরয হয় এবং কখন, কিভাবে আদায় করতে হবে, সে সম্পর্কে তিনটি ছুরত বর্ণিত আছে-
১. دين قوى (দাইনে ক্বউয়ী) অর্থাৎ শক্ত বা প্রথম নম্বরের ঋণ। যা ব্যবসার মালের মূল্য খরিদদারের কাছে পাওনা রয়েছে অথবা কর্জে হাসানা যা দেনাদারের কাছে পাওনা রয়েছে ইত্যদি প্রকার ঋণকে “দাইনে ক্বউয়ী” বলে। এই “দাইনে ক্বউয়ী” যদি নিছাব পরিমাণ হয় আর তা যদি দেনাদার ও করজদারের কাছে বছরব্যাপী পড়ে থাকে, এ অবস্থায় পাওনাদারের উপর যাকাত আদায় করা তখনই ফরয হবে যখন কমপক্ষে নিছাবের পঞ্চমাংশ টাকা তার হস্তগত হবে। তখন পূর্ববর্তী বছরের অর্থাৎ যখন থেকে যাকাত ফরয হয়েছে তখন থেকে হিসাব করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই এক পঞ্চমাংশেরই যাকাত আদায় করা পাওনাদারের উপর ফরয। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাকী টাকারও যাকাত আদায় করবে।
২. دين متوسط অর্থাৎ মধ্যম বা দ্বিতীয় নম্বরের ঋণ হলো ব্যবসাবিহীন মালের বদল। যথা খোরাকীর শস্য অথবা সওয়ারীর ঘোড়া বা খিদমতের গোলাম এবং অন্য কোন বস্তু যা তার আছলী হাজতের (প্রয়োজনের) অন্তর্ভুক্ত ইত্যাদি বিক্রি করলে তার মূল্য ক্রয়কারীর নিকট বাকি আছে, যা নিছাব পরিমাণ। এই অবস্থায় যাকাত দেয়া তখনই ফরয হবে, যখন নিছাব পরিমাণ টাকা হস্তগত হবে। তখন পুর্ববর্তী বছরের অর্থাৎ যখন থেকে যাকাত ফরয হয়েছে তখন থেকেই হিসাব করে বর্তমান সময় পর্যন্ত যাকাত দিতে হবে।
৩. دين ضعيف অর্থাৎ দুর্বল বা তৃতীয় নম্বরের ঋণ। যা মাল ছাড়া অন্য কোন বস্তুর পরিবর্তে হবে, যথা- আহলিয়ার মোহর, খোলার বদল অথবা ঘর বা দোকান যা ব্যবসার নিয়তে ক্রয় করেনি, উহার কেরায়া (ভাড়া) কেরায়াদারের নিকট বাকী রয়েছে। তা যদি নিছাব পরিমাণ হয় তহলে উক্ত টাকা হস্তগত হওয়ার পর থেকে বছর গণনা করতে হবে। অর্থাৎ হস্তগত হওয়ার পর এক বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত যাকাত ফরয হবেনা। (দুররুল মুখতার, রদ্দুল মুহতার, আলমগীরী, শামী, শরহে বেকায়া, কুদুরী, বাহরুর রায়েক, হেদায়া, আইনুল হেদায়া, এনায়া, ও কাজীখান ইত্যাদি)
আরেকটি বিধান হলো কোন ব্যক্তি কাউকে কোন কিছু কেনার জন্যে টাকা দিলো। টাকা গ্রহীতা যদি উক্ত বস্তু বা টাকা ফেরত দেয় উক্ত যাকাত আদায়ের নিয়ম নি¤œরূপ হবে-
উদাহরণস্বরূপ কোন ব্যক্তি টাকা গ্রহীতাকে একটি জমি ক্রয়ের জন্যে কিছু টাকা দিলো। এমতাবস্থায় বাসস্থানের উদ্দেশ্যে অথবা চাষাবাদ করার উদ্দেশ্যে যদি জমি কেনার জন্যে টাকা দিয়ে থাকে তাহলে সে টাকার যাকাত দিতে হবে না।
এখন, টাকা গ্রহীতা যদি জমি না দিয়ে টাকা ফেরত দেয়; আর সে টাকা যদি নিছাব পরিমাণ হয় এবং বছর পূর্ণ হয় তাহলে সে টাকারও যাকাত দিতে হবে। আর যদি ব্যবসার উদ্দেশ্যে জমি কেনার জন্যে টাকা দিয়ে থাকে তাহলে সে টাকার অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হবে। জমিদাতা যদি জমি না দিয়ে টাকা আটকে রাখে তবে টাকা দাতা ইচ্ছা করলে তখনও যাকাত আদায় করতে পারে অথবা যখন জমি অথবা টাকা পাওয়া যাবে তখন যত বছর এ অবস্থায় অতিবাহিত হয়েছে ততো বছরেরই যাকাত অবশ্যই আদায় করতে পারবে।
ব্যবসায়িক মালের মূল্যের উপর যাকাত দিতে হবে : একটা লোক মালের ব্যবসা করবে। সে ১০ লাখ টাকার জিনিস কিনলো। এখন এই মালের দাম ২০ লাখ টাকা হয়ে গেছে। পটুজি ছিলো ১০ লাখ। ২০ লাখ হলেই সে আর ২০ লাখ টাকা পাচ্ছে না। কারণ যদি মালের দাম ৫ লাখ টাকা হয়ে যায় তাহলে কি করবে। বিক্রি করার আগ পর্যন্ত কেনা দামই থাকবে। যখন বিক্রি করে ফেললো, বেশি দাম পেলো তখন বেশি দামের উপরই যাকাত দিতে হবে।
মাল কিনলো ১০ লাখ টাকা দিয়ে কিন্তু এটা এখন বাজারে ৫ লাখ টাকা হয়ে গেছে তাহলে তাকে ৫ লাখ টাকার উপরই যাকাত দিতে হবে। যেহেতু এটা বাজার দরের উপর নির্ভর করে।
একটা লোক স্বর্ণের ব্যবসা করে তার যাকাতের এক হুকুম আর স্বর্ণ যে ব্যবহার করে তার আরেক হুকুম। দুই জনের দুই হুকুম।
একটা লোক স্বর্ণ কিনলো ১০ কোটি টাকার। বাজার দর এটার দাম আছে ১৪ কোটি টাকা বা ১৫ কোটি টাকা, তাহলে সে ১০ কোটি টাকার যাকাত দিবে। বিক্রিত দামে নয়, কেনা দামে। আর একটা লোক স্বর্ণ কিনলো, সে ব্যবহার করে। তার ১০০ ভরি স্বর্ণ আছে। ১০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছিলো ১০ লাখ টাকা দিয়ে এখন এটা ৫০ লাখ টাকা হয়েছে। তাহলে তাকে ৫০ লাখ টাকার উপর যাকাত দিতে হবে। দুইটার দুই হুকুম। এই জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে কিনলো তার পটুজিতো সেটা। এখন ৫ লাখ টাকার জিনিস ২৫ লাখ টাকা বিক্রি করলে তখন তাকে ২৫ লাখ টাকার উপর যাকাত দিতে হবে। কারণ নিছাব আগেই হয়েছে।
লাভ-ক্ষতি দুটাই হিসাব করতে হবে। একটা হিসাব করলে হবে না। দুটাই হিসাব করতে হবে। দুইটা হিসাব করলে তাহলে বুঝতে সহজ।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সম্মানিত যাকাত আদায়ের বিধান : সাধারণভাবে যারা রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করে তার কিছুই নেই। অর্থাৎ জমির মালিকের সাথে চুক্তি করে বাড়ি নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করে। এই ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত পটুজির হিসাব করতে হবে। এখানে ফ্ল্যাটের দাম দেখা যাবে না।
একটা লোক ৫০ লক্ষ টাকা পটুজি নিয়ে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করলো। অতঃপর ১০ জন মালিকের সাথে চুক্তি করলো, জায়গা নিলো, ৫ কোটি টাকা লোন নিয়ে ফ্ল্যাটগুলো করতে থাকলো, এগুলো সে বিক্রি করবে, লাভ করবে। সে যে ৫০ লক্ষ টাকা নিয়োগ করছে, এটা তার ব্যবসার মাল, মূল পুজি। এটার উপর অর্থাৎ তার মূল পুজি ৫০ লক্ষ টাকারই যাকাত দিতে হবে। ঐ ৫ কোটি টাকার জন্যে ৫০ লক্ষ টাকা মাইনাস হবে না। ঐ ৫ কোটি টাকার বিল্ডিং আছে। ঐ বিল্ডিংগুলো সে যেহেতু বানিয়ে বিক্রি করবে সেটাতো তার মালিকানা বা অধীনে না। কারণ যে কোন কিছুর যাকাত দিতে হলে ঐটা তার মালিকানায় ১ বছর থাকতে হবে। এখন ঐটা তৈরি করা হলে বিক্রি করে যে লাভটা হবে সেই লাভটা যদি ১ বছর থাকে তাহলে তার নিছাব হবে।
ঔষধ কোম্পানীগুলোর সম্মানিত যাকাত আদায়ের বিধান : ঔষধ কোম্পানীগুলোর ব্যাঙ্কে টাকা জমা থাকে। আবার মার্কেটে বহু টাকার প্রোডাক্ট মার্কেটে/বাজারে থাকে। যে টাকা ব্যাঙ্কে আছে তার যাকাত যেমন আদায় করতে হবে, ঠিক তেমনি মার্কেটে যত টাকার প্রোডাক্ট আছে তারও যাকাত আদায় করতে হবে। তবে যে টাকা বকেয়া হিসেবে মার্কেটে আছে সেই টাকা যদি দেনাদাররা স্বীকার করে যে, আদায় করে দিবে তবে তা হস্তগত হওয়ার পূর্বেও আদায় করতে পারবে। অন্যথায় হস্তগত হওয়ার পরও আদায় করতে পারবে। আর দেনাদার যদি দেনা অস্বীকার করে অথবা টাকা দিতে অস্বীকার করে তবে সে টাকার যাকাত দিতে হবে না।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
সম্মানিত যাকাত উনার আহকাম, মাসায়িল ও ফাযায়িল (৯)
৩০ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ছবি তোলা হারাম ও নাজায়িয
৩০ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
৩০ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
তারা প্রত্যেকেই মূর্তিপূজারী ও মুশরিক হয়ে কাট্টা কাফির ও মুরতাদ হয়েছে (২৫)
৩০ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
সারাবিশ্বে এক দিনে ঈদ পালন সম্ভব কি? একটি দলীলভিত্তিক বিশ্লেষণ.... (৬)
৩০ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
পর্দা করা ফরজ, বেপর্দা হওয়া হারাম
২৯ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২৯ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
তারা প্রত্যেকেই মূর্তিপূজারী ও মুশরিক হয়ে কাট্টা কাফির ও মুরতাদ হয়েছে (২৪)
২৯ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সারাবিশ্বে এক দিনে ঈদ পালন সম্ভব কি? একটি দলীলভিত্তিক বিশ্লেষণ.... (৫)
২৯ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সম্মানিত যাকাত উনার আহকাম, মাসায়িল ও ফাযায়িল (৭)
২৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ছবি তোলা হারাম ও নাজায়িজ
২৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার)