ইলমে তাছাওউফ
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৩১)
কামিল শায়েখ উনার প্রতি সর্বক্ষেত্রে বিশুদ্ধ আক্বীদা ও হুসনে যন পোষণ করা মুরীদের জন্য কামিয়াবী হাছিলের কারণ
, ২৪ ছফর শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ০২ রবি , ১৩৯২ শামসী সন , ৩০ আগষ্ট, ২০২৪ খ্রি:, ১৫ ভাদ্র , ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) ইলমে তাছাউফ
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَىْ كُلِّ مُسْلِمِ وَّ مُسْلِمَا.
অর্থ: প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ইলিম তলব করা ফরয।”
হযরত মোল্লা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি ইলমে ফিক্বাহ তলব (অর্জন) করেছেন। এখন ইলমে তাছাওউফ হাছিল করতে হবে। অনেক কামিল শায়েখ উনাদের কাছে তিনি গিয়েছেন, কিন্তু কাউকে পছন্দ হয় না। যেহেতু উনি বড় আলেম, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই করেন। যার জন্য উনার মনের সাথে মিলে না। শেষ পর্যন্ত এক লোক উনাকে পরামর্শ দিলেন, অমুক স্থানে একজন বুযূর্গ রয়েছেন, যার নাম হযরত খাজা ওবায়দুল্লাহ আহরার রহমতুল্লাহি আলাইহি। যিনি নক্বশবন্দ সিলসিলার পূর্ববর্তী বুযূর্গ। উনার ছোহবতে যান, উনি মহান আল্লাহ পাক উনার খালিছ ওলী। সে ব্যক্তির কথামত হযরত মোল্লা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি অনেক দূর থেকে সফর করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে এসে উপস্থিত হলেন হযরত খাজা ওবায়দুল্লাহ আহরার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বাড়ীতে। বাড়ীতে এসে দেখেন উনার বাড়ীটা খুব বড়, সামনে অনেক বড় উঠান অর্থাৎ মাঠের মত জায়গা, সে মাঠে স্তূপ করা রয়েছে- ধান, চাল, গম, নানা প্রকার শস্য, ফল-ফলাদি। সেটা দেখে হযরত মোল্লা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি মনে মনে চিন্তা করলেন, এটা আবার কোনটা? আমাকে তো বলে পাঠানো হলো যে, উনি খুব বড় বুযূর্গ, মহান আল্লাহ পাক উনার বড় ওলী। অথচ এত বড় বাড়ী, এত সম্পদ! এত শান-শওকত! কি করে উনার পক্ষে বুযূর্গ আল্লাহওয়ালা হওয়া সম্ভব! উনি মনে মনে চিন্তা করলেন। যেহেতু উনি ফারসী কবিও ছিলেন, তাই আপছে আপ কথাটা বের হয়ে গেল যে-
انكه نه مردست كه دنيا دوست دارد
অর্থ: “ঐ ব্যক্তির পক্ষে মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী হওয়া কি করে সম্ভব, যে দুনিয়াকে মুহব্বত করে” এটা ফিকির করে উনার সাথে সাক্ষাত করার প্রয়োজনই মনে করলেন না। হযরত খাজা ওবায়দুল্লাহ আহরার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বাড়ীর কাছে একটা মসজিদ ছিল, সেই মসজিদে উপস্থিত হয়ে তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন, এখানেই একটু বিশ্রাম নিয়ে নেই।
যেহেতু আগেকার যুগে হোটেল ছিলো না। আর বিশ্রাম নেয়ার মতো সরাইখানা, লঙ্গরখানাও সব জায়গায় ছিলো না। হযরত খাজা ওবায়দুল্লাহ আহরার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বাড়ীতেই ছিল সেই খানক্বা শরীফ, বিশ্রাম নেয়ার মতো জায়গা, কিন্তু উনি সেখানে উঠেননি। উঠলেন গিয়ে মসজিদে। এত ক্লান্ত, শ্রান্ত যে, শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলেন।
ঘুমিয়ে স্বপ্নে দেখতে পেলেন যে, ক্বিয়ামত কায়েম হয়ে গিয়েছে। সমস্ত লোক ইয়া নাফ্সী, ইয়া নাফ্সী বলতেছে। নাযাতের জন্য একেকজন অস্থির, পেরেশান হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ কিছু লোক কোথা থেকে এসে হযরত মোল্লা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে পাকড়াও করলো যে, হে মোল্লা জামী! আপনি দেখুন, ক্বিয়ামত কায়েম হয়ে গিয়েছে, আপনার কাছে আমরা কিছু পাওনা ছিলাম, হয় আপনি আমাদের পাওনা ফিরিয়ে দিন নতুবা আমরা মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করে আপনার যত নেকী রয়েছে, তা আমরা নিয়ে নিব। উনি বললেন, দেখ! আমি তো বুঝতে পারিনি যে, এত তাড়াতাড়ি ক্বিয়ামত কায়েম হয়ে যাবে। আমি যদি বুঝতে পারতাম, তাহলে তোমাদের জন্য একটা ব্যবস্থা করতাম। উনি তাড়াতাড়ি ছুটার জন্য কোশেশ করলেন। সেই হাশরের ময়দানে মহান আল্লাহ পাক উনার এক ওলী, উনি ঘোড়ায় সাওয়ার হয়ে ইতমিনানের সাথে ঘোরা-ফেরা করতেছেন। সম্পূর্ণ হাশরের ময়দান উনি পর্যবেক্ষণ করছেন, কাকে উদ্ধার করা যেতে পারে। উনি যখন দূর থেকে দেখলেন, হযরত মোল্লা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে লোকেরা পাকড়াও করেছে, তখন সেই মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী এসে বললেন, হে ব্যক্তি! আপনার কি হয়েছে? তখন সমস্ত লোকেরা বললো যে, হুযূর! এ লোক আমাদের নিকট থেকে টাকা নিয়েছে, আমাদের সঙ্গে কথা ছিল পরিশোধ করে দেয়ার কিন্তু হঠাৎ করে ক্বিয়ামত হয়ে গিয়েছে। তিনি টাকা পরিশোধ করেননি। এখন হয় তিনি আমাদের মাল-সামানা ফিরিয়ে দিক, অন্যথায় আমরা মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে উনার বিরুদ্ধে নালিশ করে উনার সমস্ত নেকীগুলো নিয়ে নিব। এখন তিনি কি করবেন করুক। উনি তখন লা-জাওয়াব, উনি বললেন, আমি কি করবো? আমি তো জানি না যে, হঠাৎ করে ক্বিয়ামত কায়েম হয়ে যাবে। তখন সেই বুযূর্গ ব্যক্তি বললেন, হে মোল্লা জামী! আপনি আমার বাড়ীতে গিয়েছিলেন না? সেখানে তো দেখেছেন যে, অনেক স্তুপকৃত ধনভান্ডার, মাল-সম্পদ রয়েছে, আপনি তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে সেখান থেকে কিছু মাল-সম্পদ এনে আপনার কর্জ পরিশোধ করে দিন। আপনার মত যারা অভাবগ্রস্থ রয়েছে, উনাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্যই তো আমার সেই সম্পদগুলো রেখেছি।
হাক্বীক্বত আমি দুনিয়াবী কোন ফায়দা হাছিলের জন্য রাখিনি। এদিকে যোহরের আযান হয়ে গেল। উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠেই মসজিদের প্রধান ফটকের দিকে উনার দৃষ্টি গেল, একটা লোক মসজিদে প্রবেশ করছেন, এ লোকই সেই লোক! যে লোককে উনি দেখেছেন হাশরের ময়দানে ঘোড়ার উপর সাওয়ার হয়ে ঘুরছেন। উনাকে দেখে হযরত মোল্লা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। মূলত উনি হচ্ছেন, হযরত খাজা ওবায়দুল্লাহ আহরার রহমতুল্লাহি আলাইহি।
উনি তাড়াতাড়ি মসজিদ থেকে বের হয়ে অযূ-ইস্তেঞ্জা সেরে ফিরে আসলেন। নামায-কালাম শেষ হয়ে গেল। উনি ধীরে ধীরে কম্পিত পায়ে এসে আদবের সাথে বললেন, হুযূর! আমি তো অনেক দূর থেকে এসেছি আপনার কাছে বাইয়াত হওয়ার জন্য। দয়া করে আমাকে বাইয়াত করান। হযরত খাজা ওবায়দুল্লাহ আহরার রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনাকে একবার ভাল করে দেখলেন আপাদমস্তক। দেখে বললেন, কি হে মোল্লা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনি তো আমার বাড়ীতে গিয়েছিলেন? কি গিয়েছিলেন না? উনি চুপ হয়ে গেলেন। আপনি আমার বাড়ীতে গিয়ে কি বলেছিলেন? উনি তো আরো লজ্জিত হয়ে গেলেন। উনি আর একবার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি আমার বাড়ীতে গিয়েছিলেন? কি বলেছিলেন সেখানে গিয়ে? কথা না বললে আদবের খেলাফ, বলাটাও আদবের খেলাফ। উনি বললেন, হুযূর! বেয়াদবী মাফ করবেন, আমি বুঝতে পারিনি। উনি বললেন, কি বলেছিলেন সেটা বলুন? আপনাকে তো শোধরাতে হবে। তখন বললেন, হুযূর! আমি আপনার এত সম্পদ দেখে বলেছিলাম-
انكه نه مردست كه دنيا دوست دارد
অর্থাৎ ঐ ব্যক্তির পক্ষে কি করে আল্লাহওয়ালা হওয়া সম্ভব, যে দুনিয়াকে মুহব্বত করে।”
হুযূর! বেয়াদবী মাফ করবেন, ভুল হয়ে গেছে। হযরত ওবায়দুল্লাহ আহরার রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, আপনার কথা শুদ্ধই রয়েছে হে মোল্লা জামী! তবে কথাটা অর্ধেক হয়েছে। আরেকটা লাইন আপনি যোগ করে দিন, তাহলে পূর্ণ হয়ে যাবে। সেটা কি? সেটা হলো-
اگر دارد برائے دوست دارد
হ্যাঁ, যে দুনিয়ার সম্পদের মোহে মোহগ্রস্ত হয়েছে, সে অবশ্যই দুনিয়াদার, সে কখনো মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী হতে পারে না। তবে যদি কেউ সম্পদ রাখে মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য, তাহলে তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী। তাতে সন্দেহ নেই। সুবহানাল্লাহ!
উপরোক্ত ওয়াকেয়া দ্বারা এটাই প্রতিভাত হয় যে, হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের অথবা নিজ কামিল শায়েখ উনার যেন কোন আচার-ব্যবহার, আমল, চলা-ফেরা ইত্যাদির প্রতি সন্দেহ পোষন করা মুরীদের জন্য কখনও কল্যাণকর নয় বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে কামিল শায়েখের প্রতি শুদ্ধ, স্বচ্ছ ও উত্তম ধারণা অর্থাৎ বিশুদ্ধ আক্বীদা ও হুসনে যন রাখাটাই আদব। (অসমাপ্ত)
-আল্লামা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
পবিত্র ছোহবত মুবারক গ্রহণের ফাযায়িল-ফযীলত, গুরুত্ব-তাৎপর্য ও আবশ্যকতা
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
পবিত্র ছোহবত মুবারক গ্রহণের ফাযায়িল-ফযীলত, গুরুত্ব-তাৎপর্য ও আবশ্যকতা
১১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
যামানার মূল নায়িবে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে তায়াল্লুক-নিসবত ব্যতীত খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সাথে তায়াল্লুক-নিসবত মুবারক রাখার দাবি বাতুলতার নামান্তর
০৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
যামানার মূল নায়িবে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে তায়াল্লুক-নিসবত ব্যতীত খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সাথে তায়াল্লুক-নিসবত মুবারক রাখার দাবি বাতুলতার নামান্তর
২৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
তাযকিয়াহ বা ইছলাহ অর্জন করা ব্যতীত কোনো বান্দার পক্ষে কামিয়াবী হাছিল করা সম্ভব নয়
১৪ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
মুর্শিদ বা শায়েখ হক্ব বা নাহক্ব তা যাচাই-বাছাই করার পর বাইয়াত হতে হবে
০৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
তাসাউফ চর্চা ছাড়া দ্বীন ইসলাম কায়েম সম্ভব না (২)
০১ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
হযরত মুর্শিদ বা শায়েখ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার নিকট বাইয়াত হওয়ার ক্ষেত্রে সন্তানের জন্য পিতা-মাতা উনাদের এবং স্ত্রীর জন্য স্বামীর বাধা গ্রহণযোগ্য নয়
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
তাসাউফ চর্চা ছাড়া দ্বীন ইসলাম কায়েম সম্ভব না (১)
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চীশতী আজমিরী সাঞ্জারী রহমতুল্লাহি আলাইহি (৩১)
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
পিতা-মাতা জীবিত থাকতেই মুর্শিদ বা শায়েখ আলাইহিস সালাম উনার নিকট বাইয়াত হওয়া উচিত
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
পিতা-মাতা জীবিত থাকতেই মুর্শিদ বা শায়েখ আলাইহিস সালাম উনার নিকট বাইয়াত হওয়া উচিত
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার)