ইলমে তাছাওউফ
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২১)
সালিক বা মুরীদ তার গুরুত্বপূর্ণ সকল কাজ যথাযথভাবে শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার দিক-নির্দেশনা মুবারক অনুযায়ী করবে
, ১৮ শাওওয়াল শরীফ, ১৪৪৫ হিজরী সন, ২৯ হাদী আশার, ১৩৯১ শামসী সন , ২৮ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রি:, ১৫ বৈশাখ, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) ইলমে তাছাউফ
রুহুল মায়ানী গ্রন্থকার বলেছেন, “ফক্বীহ ও ছূফী বা ইবাদতকারীদের কাছে পরামর্শ না নিয়ে ফাসিক-ফুজ্জার ও বেদ্বীন, বদদ্বীনদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করলে সুফলের চেয়ে কুফলই বেশী হতে পারে। ” পবিত্র হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে-
إِسْتَرْشِدُوا العَاقِلَ تَرْشُدُوْا وَلَا تَعْصُوْهُ فَتَنْدَمُوْا
অর্থ: “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “জ্ঞানী ব্যক্তিদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করবে এবং উনাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে না, অন্যথায় অনুতাপ করতে হবে। ” (তাফসীরে আদ্ দুররুল মানছুর, জালালাইন, মাযহারী, রুহুল মায়ানী, মায়ারেফুল কুরআন, বয়ানুল কুরআন, বায়হাক্বী শরীফ ও ইবনে আদী)
আর “উলুল আলবাব” বা জ্ঞানী ব্যক্তিদের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার আয়াত শরীফ উল্লেখ করে ইরশাদ মুবারক করেন-
اَلَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ قِيَامًا وَّقُعُوْدًا وَّعَلٰى جُنُوْبِهِمْ
অর্থ: “উনারাই হচ্ছেন জ্ঞানী ব্যক্তি, যারা দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া অর্থাৎ সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরে লিপ্ত। ’ (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ- ১৯১)
অন্য আয়াত শরীফে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
অর্থ: “তোমরা যারা জানো না, তারা আহলে যিকির আল্লাহওয়ালা, হক্কানী-রব্বানী আলিম উনাদেরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও। ” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ- ৪৩)
মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُوْنَ وَجْهَهٗ
অর্থ: উনাদের ছোহবতকে লাযেম (অত্যাবশ্যক) করে নাও যারা সকাল-সন্ধ্যা (সর্বাবস্থায়) মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টির জন্য যিকিরে মশগুল থাকেন। (পবিত্র সূরা কাহাফ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ- ২৮)
অর্থাৎ নিজেকে ওই সকল ব্যক্তিদেরই ছোহবতে কুরবান বা উৎসর্গ করতে হবে, সর্বপ্রকার সম্পর্ক ও মনোযোগ উনাদের দিকে রাখতে হবে এবং যে কোন কাজে উনাদের কাছ থেকেই নির্দেশনা নিতে হবে। কেননা, উনারা সব সময় সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির-ফিকির, ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল। উনারা উনাদের আমল মুবারক একান্তভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার রেযামন্দী-সন্তুষ্টি মুবারক হাছিলের লক্ষ্যেই করেন। যার কারণে উনারাই ভালো জানেন কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। পরিশেষে উনারাই সাহায্য ও বিজয় লাভ করেন। ” কাজেই উনাদের পরামর্শ বা দিক-নির্দেশনা নিতে হবে। (তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন)
অতএব উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, পারস্পরিক পরামর্শ ভিত্তিক কাজ করা মহান আল্লাহ পাক উনার সুন্নত, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।
কাজেই প্রত্যেক মুরীদের জন্য একান্ত দায়িত্ব-কর্তব্য হচ্ছে, তার গুরুত্বপূর্ণ সকল কাজ করার পূর্বে নিজ শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনাকে জানিয়ে উনার দিক-নির্দেশনা মুবারক অনুযায়ী সমস্ত কিছু সম্পন্ন করা। আর তিনি যা নির্দেশ মুবারক করবেন তা বিনা চূ-চেরায় মেনে নেয়া। অন্যথায় মুরীদের জন্য ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। একটি ঘটনা হতে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়-
হযরত মনছুর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বছরায় অবস্থানকালে মাঝে মাঝে সেখানকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুযূর্গ হযরত আবি ইয়াকুব আখতার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট যেতেন। উনার অপূর্ব চরিত্র মাধুর্য ও ইলিমের গভীরতা দেখে হযরত আবি ইয়াকুব আখতার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে তিনি অত্যন্ত মুহব্বতের চোখে দেখতেন। হযরত আবি ইয়াকুব আখতার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার একজন খুব ছূরত, আলিমা এবং মুত্তাক্বী বিবাহযোগ্যা মেয়ে ছিলেন। তিনি উনার এ মেয়েকে হযরত মনছুর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে বিবাহ দিতে ইচ্ছা পোষণ করলেন। একবার তিনি নিজেই হযরত মনছুর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণ করেন। হযরত মনছুর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এতে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। তবে শর্ত দিলেন, আমার মুর্শিদ ক্বিবলা হযরত আমর ইবনে উছমান মাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অনুমতি নিতে হবে। অতঃপর তিনি উনার মুর্শিদ ক্বিবলা উনাকে বিষয়টি জানিয়ে অনুমতির অপেক্ষায় থাকলেন।
সব শুনে হযরত আমর ইবনে উছমান মাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন- বিবাহ শাদী করে সংসারী হওয়া এক কথা, আর তরীক্বতের পথে রিয়াজত-মাশাক্কাত করা অন্য কথা। এ দু’টি পথের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। তুমি যে পথ অবলম্বন করেছো এবং তাতে বহুদূর অগ্রসরও হয়েছো, সে অবস্থায় বিবাহ করলে তোমার তাকমীলে পৌঁছতে অনেক বাধার সৃষ্টি হবে। তুমি ব্যর্থও হতে পারো। তুমি এক কাজ করতে পারো, এই মুহূর্তে তোমার বিবাহ করা ঠিক হবে না। তুমি এখন বিবাহ করো না।
হযরত আমর ইবনে উছমান মাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার মুরীদ হযরত মনছুর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে নছীহতমূলক উপদেশ প্রদান করলেন, কিন্তু হযরত মনছুর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মনে বিবাহ করার ইচ্ছা অত্যন্ত প্রবল হয়েছিল, এ জন্য তিনি উনার শায়েখের আদেশ মুবারক বুঝতে না পেরে উনাকে না জানিয়েই বিবাহ সম্পন্ন করেন।
অন্যদিকে হযরত আবি ইয়াকুব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনাকে নানাভাবে বুঝিয়ে বিবাহ করার জন্য উৎসাহিত করে উনাকে রাজী করাতে সমর্থ্য হন। এর কিছু দিনের মধ্যেই হযরত আমর ইবনে উছমান মাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বিষয়টি জানতে পারলেন।
এ কারণে হযরত আমর ইবনে উছমান মাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি কষ্ট পেলেন এবং মনছুর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি হযরত আবি ইয়াকুব রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রতিও আশ্চর্য হলেন যে, উনার ন্যায় একজন বুযূর্গ ব্যক্তি তুচ্ছ পার্থিব স্বার্থের খাতিরে হযরত মনছুর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মত একজন উত্তম ব্যক্তিকে নিসবত-কুরবত মুবারক হাছিলের কোশেশে বিঘœ সৃষ্টি করলেন! (চলবে)
-আল্লামা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
যামানার মূল নায়িবে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে তায়াল্লুক-নিসবত ব্যতীত খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সাথে তায়াল্লুক-নিসবত মুবারক রাখার দাবি বাতুলতার নামান্তর
০৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
যামানার মূল নায়িবে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে তায়াল্লুক-নিসবত ব্যতীত খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সাথে তায়াল্লুক-নিসবত মুবারক রাখার দাবি বাতুলতার নামান্তর
২৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
তাযকিয়াহ বা ইছলাহ অর্জন করা ব্যতীত কোনো বান্দার পক্ষে কামিয়াবী হাছিল করা সম্ভব নয়
১৪ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
মুর্শিদ বা শায়েখ হক্ব বা নাহক্ব তা যাচাই-বাছাই করার পর বাইয়াত হতে হবে
০৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
তাসাউফ চর্চা ছাড়া দ্বীন ইসলাম কায়েম সম্ভব না (২)
০১ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
হযরত মুর্শিদ বা শায়েখ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার নিকট বাইয়াত হওয়ার ক্ষেত্রে সন্তানের জন্য পিতা-মাতা উনাদের এবং স্ত্রীর জন্য স্বামীর বাধা গ্রহণযোগ্য নয়
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
তাসাউফ চর্চা ছাড়া দ্বীন ইসলাম কায়েম সম্ভব না (১)
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চীশতী আজমিরী সাঞ্জারী রহমতুল্লাহি আলাইহি (৩১)
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
পিতা-মাতা জীবিত থাকতেই মুর্শিদ বা শায়েখ আলাইহিস সালাম উনার নিকট বাইয়াত হওয়া উচিত
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
পিতা-মাতা জীবিত থাকতেই মুর্শিদ বা শায়েখ আলাইহিস সালাম উনার নিকট বাইয়াত হওয়া উচিত
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
পিতা-মাতা জীবিত থাকতেই মুর্শিদ বা শায়েখ আলাইহিস সালাম উনার নিকট বাইয়াত হওয়া উচিত
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
পবিত্র দশ লতিফা উনাদের বিবরণ
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার)