জীবনী মুবারক
বিশিষ্ট মহিলা ছাহাবী হযরত আসমা বিনতু আবী বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা (৪)
(গতকালকের পর)
, ০৯ রবীউল আউওয়াল শরীফ, ১৪৪৫ হিজরী সন, ২৭ রবি’ ১৩৯১ শামসী সন , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রি:, ১০ আশ্বিন, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) পবিত্র দ্বীন শিক্ষা
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার শাহাদাত মুবারকের কিছুদিনের মধ্যেই হিজরী ৭৩ সনে হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনিও পবিত্র বিছাল শরীফ গ্রহণ করেন। তখন উনার বয়স মুবারক হয়েছিল ১০০ বৎসর। হযরত মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না উনাদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষে ওফাতপ্রাপ্ত হন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)
উনার স্বাস্থ্য অত্যন্ত ভাল ছিল। তিনি ১০০ বৎসর জীবিত ছিলেন। উনার বার্ধক্যজনিত বুদ্ধি বিভ্রম ঘটেনি। দাঁতও সবগুলি অটুট ছিল।
ফযীলত ও মর্যাদা:
নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনাকে “যাতুন নিত্বাকাইন” (দুই নিত্বাক বা কোমরবন্ধের অধিকারিণী) উপাধি দিয়েছিলেন, কারণ হিজরতের সময় তিনি উনার কোমর বন্ধকে দুই ভাগ করে একটি দিয়ে ছফরের জন্য খাদ্যদ্রব্যের থলের মুখ বেঁধে দিয়েছিলেন এবং অন্য অংশ দিয়ে পানির মশকের মুখ বেঁধে দিয়েছিলেন।
হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি ছিলেন তীক্ষè বুদ্ধিমতী। উনার বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন সংকটের সময়। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আফদ্বালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাদের হিজরতের খবর পবিত্র মক্কা শরীফে ছড়িয়ে পড়লে পরদিন আবু জাহেল ও আরো কতিপয় কুরাইশ নেতা সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার বাড়ীতে আসে এবং হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনাকে সামনে পেয়ে তারা উনাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনার বাবা কোথায়? তিনি উত্তর দিলেন, তিনি এখন কোথায় আমি কি করে বলব? এ উত্তর শুনে নরাধম আবু জাহেল উনার গালে এমন জোরে থাপ্পড় দেয় যে, উনার কানের দুল দু’টি ছিটকে পড়ে যায় এবং তিনি মাটিতে পড়ে যান। নাঊযুবিল্লাহ!
হিজরতের সময় নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ও সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম ছাওর পর্বতের গুহায় অবস্থানকালে রাতের অন্ধকারে হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনাদের জন্য খাবার ও পানীয় নিয়ে যেতেন।
উনার পিতা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি হিজরতের সময় যাবতীয় নগদ অর্থ সাথে নিয়ে যান। দাদা হযরত আবু কুহাফা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু (তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি) তা জানতে পেরে বললেন, তিনি জান ও মাল উভয় ধরনের কষ্ট দিয়ে গেলেন। হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি দাদাকে বললেন, না, তিনি অনেক সম্পদ রেখে গেছেন। এ কথা বলে সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম যেখানে অর্থ-সম্পদ রাখতেন সেখানে পাথর রেখে দিলেন। অতঃপর তিনি হযরত আবু কুহাফা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ডেকে এনে বললেন, দেখুন, তিনি এসব রেখে গেছেন। তিনি কাপড়ে ঢাকা পাথরগুলির উপর হাত বুলিয়ে দেখে মনে করলেন এগুলি টাকা পয়সা। হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, আমি আমার দাদাকে সান্তনা দেয়ার জন্যই এরূপ করেছিলাম। নতুবা সেখানে পাথর ব্যতীত কোন টাকা পয়সা ছিল না।
হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা অত্যন্ত উদারচিত্ত, ধৈর্যশীলা ও অল্পে তুষ্ট স্বভাবের ছিলেন। হযরত যুবাইর বিন আওওয়াম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সঙ্গে যে সময় উনার শাদী মুবারক হয়, তখন হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অনেক সম্পদশালী ছিলেন না। হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার কোন চাকর-বাকর ছিল না এবং একটি মাত্র ঘোড়া ছাড়া পরিবারের প্রয়োজন মিটানোর জন্য কোন বিশেষ সম্পদও ছিল না। তিনি আহাল বা স্বামীর সেবা করতেন, নিজ হাতে উনার ঘোড়াটির জন্য ভুষি পিষতেন এবং তার তত্ত্বাবধান করতেন। নিজের আহাল বা স্বামীর জমি হতে খেজুরের আঁটি কুড়িয়ে কুড়িয়ে নিজের মাথায় নিতেন এবং বহু পথ অতিক্রম করে বাড়ীতে ফিরতেন। জমিটি ছিল পোনে এক ফারসাখ দূরে। তিনি বলেন, একদিন আমি খেজুরের আঁটি মাথায় করে ঘরে ফিরছি, এমন সময় পথে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে দেখা। উনার সাথে তখন আরো কয়েকজন লোক ছিলেন। তিনি আমাকে ডাকলেন এবং উনার বাহনের পিঠে উঠে বসার জন্য বললেন। কিন্তু আমি লজ্জায় বাহনে উঠলাম না। বাড়ী ফিরে আমি এ ঘটনার কথা হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে বললাম। এবার পিতা সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম আমার জন্য একটি চাকর দেন। সেই তখন ঘোড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে যেন এ দায়িত্ব নিয়ে আমাকে মুক্তি দিল। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, তাবাকাত)
মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাকে ধন-সম্পদ দান করেছিলেন। তিনি উহা দান করতে কুন্ঠা বোধ করেননি। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে সাইয়্যিদাতুনা হযরত উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছাহ ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার একটি তৃণভূমি লাভ করেন এবং উহা এক লক্ষ দিরহামে বিক্রয় করে সমুদয় অর্থ আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বন্টন করে দেন। উনার পুত্র হযরত আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি আমার মা হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ও খালা হযরত উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছাহ ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনাদের থেকে অধিক দানশীলা কোন নারী দেখিনি। তবে উনাদের দু’জনের দানের নিয়ম পৃথক ছিল। আমার খালার স্বভাব ছিল, প্রথমত: তিনি বিভিন্ন জিনিষ একত্র করতেন। যখন দেখতেন যে যথেষ্ট পরিমাণ জমা হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ করে তা সবই একদিন গরীব মিসকিনদেন মাঝে বিলিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার মাতার স্বভাব ছিল ভিন্নরূপ। তিনি আগামীকাল পর্যন্ত কোন জিনিষ নিজের জন্য জমা করে রাখতেন না। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)
শরীয়তের উপর উনার এরূপ প্রবল নিষ্ঠা ছিল যে, একবার উনার মাতা পবিত্র মদীনা শরীফে এসে কিছু সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত মুবারকে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তিনি উনার মুশরিক মাতাকে সাহায্য করতে পারবেন কিনা? নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি আত্মীয়তার বন্ধন সূদৃঢ় করতে নিষেধ করেন না।
হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি বিনীত ও বিনম্রভাবে ইবাদতে মশগুল থাকতেন এবং একাগ্রচিত্তে পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন। বিশেষ কোন আয়াত শরীফ পাঠের সময় বার বার তা আওড়াতে থাকতেন। উনার আহাল বা স্বামী বর্ণনা করেন, আমি একদিন হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার ঘরে প্রবেশ করে দেখি তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে এই আয়াত শরীফ
فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَ وَقَانَا عَذَابَ السَّعِيْرِ
(অতঃপর আমাদের প্রতি মহান আল্লাহ পাক তিনি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন) পাঠ করলেন। তারপর পাঠ করলেন আউযুবিল্লাহ। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম, কিন্তু তিনি কাঁদছেন এবং আউযুবিল্লাহ পাঠ করছেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি বাজারে গেলাম। কাজ সেরে আবার সেখানে ফিরে গিয়ে দেখলাম, তখনো তিনি কাঁদছেন, আর আউযুবিল্লাহ পাঠ করছেন। (হিলইয়াতুল আউলিয়া)
হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার থেকে ৫৬টি হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে। ১৩টি মুত্তাফাক আলাইহি, বুখারী শরীফে পাঁচটি ও মুসলিম শরীফে চারটি এককভাবে বর্ণিত হয়েছে। বহু বিশিষ্ট ছাহাবী উনার নিকট থেকে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)
সূত্র: তাবাকাত, উসুদুল গাবা, হায়াতুছ ছাহাবা, সিয়ারু আলামিন নুবালা, মুসলিম শরীফ, ইছাবা, অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থ।
-আল্লামা সাঈদ আহমদ গজনবী।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
পর্দা পালন করা পুরুষ মহিলা সবার জন্য ফরজ
১৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
১৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ফিক্বাহ বা ফতওয়ার সকল কিতাবেই গান-বাজনা, বাদ্য-যন্ত্র ইত্যাদিকে হারাম ফতওয়া দেয়া হয়েছে
১৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার ঈমানদীপ্ত ঐতিহ্য (৪২)
১৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
কদমবুছী করা খাছ সুন্নত মুবারক
১৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
যে সমস্ত উলামায়ে সূ’ ও তাদের শাগরেদ নামধারী মুসলমানরা মুশরিকদের মন্দির ও পূজায় পাহারা দিয়েছে তাদের ব্যাপারে শরঈ ফায়ছালা (৩)
১৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম” কিতাবের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিরোধিতাকারীদের আপত্তির জবাব
১৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
ছবি তোলা হারাম ও নাজায়িয
১৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
১৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
প্রত্যেক মুসলমান পুরুষের জন্য দাড়ি রাখা ফরয
১৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
মূর্তি, প্রতিমা, ভাস্কর্য, ম্যানিকিন ও ছবি নাজায়িয ও হারাম
১৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
যে সমস্ত উলামায়ে সূ’ ও তাদের শাগরেদ নামধারী মুসলমানরা মুশরিকদের মন্দির ও পূজায় পাহারা দিয়েছে তাদের ব্যাপারে শরঈ ফায়ছালা (২)
১৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার)