বিদয়াতের শরয়ী অর্থ, সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ (২)
, ০১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১২:০০:০০ এএম ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) পবিত্র দ্বীন শিক্ষা
বিদয়াতের প্রকারভেদ
হযরত ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা পবিত্র শরীয়ত উনার হুকুম অনুযায়ী বিদয়াতকে প্রথমতঃ দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন-
১. বিদয়াতে ই’তিক্বাদী, অর্থাৎ আক্বীদা বা বিশ্বাসগত বিদয়াত। ২. বিদয়াতে আ’মালী, অর্থাৎ কর্মগত বিদয়াত।
(১) বিদয়াতে ই’তিক্বাদী বা আক্বীদাগত বিদয়াত হলো- যে সমস্ত আক্বীদা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের মূলনীতির বহির্ভূত। মূলতঃ এ আক্বীদাগত বিদয়াতের সবই হারামের পর্যায়ভুক্ত এবং অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন- খারিজী, মু’তাযিলা, জাবারিয়া, ক্বদরিয়া, শিয়া ইত্যাদি বাতিল ফিরক্বার আবির্ভাব। এই নব আবির্ভূত ফিরক্বার ন্যায় বদ আক্বীদা পোষণ করা সম্পূর্ণই হারাম ও কুফরী।
(২) বিদয়াতে আ’মালী বা কর্মগত বিদয়াত প্রথমতঃ দু’ভাগে বিভক্ত- (ক) বিদয়াতে হাসানাহ, (খ) বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ।
(ক) বিদয়াতে হাসানাহ আবার তিন প্রকার- (১) বিদয়াতে ওয়াজিব, (২) বিদয়াতে মুস্তাহাব ও (৩) বিদয়াতে মুবাহ।
আর এ বিদয়াতে হাসানাহ সম্পর্কেই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
مَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهٗ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِهٖ
অর্থ: যে কেউ সম্মানিত দ্বীন ইসলামে উত্তম কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন করবে (যা শরীয়তসম্মত), তার জন্য সে ছওয়াব পাবে এবং তারপরে যারা এ পদ্ধতির অনুসরণ করবে, তার ছওয়াবও সে পাবে। (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী)
উল্লেখিত পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহের দৃষ্টিতে বিদয়াতে হাসানাহকে বিদয়াত লিদদ্বীন বলা হয়। কেউ কেউ আবার উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহের দৃষ্টিতে বিদয়াতে হাসানাহকে ‘বিদয়াতে লাগউয়ীও’ বলে থাকেন। অর্থাৎ যদিও শাব্দিক অর্থে বিদয়াত বলা হয়েছে প্রকৃতপক্ষে এগুলো সুন্নত মুবারকেরই অন্তর্ভুক্ত। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে (سُنَّةً) সুন্নত শব্দ মুবারক উল্লেখ রয়েছে।
(খ) আর বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ দু’প্রকার- (১) বিদয়াতে হারাম, (২) বিদয়াতে মাকরূহ।
এই বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ সম্পর্কেই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هٰذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ
অর্থ: যে ব্যক্তি আমার এ সম্মানিত দ্বীনের মধ্যে কোন নতুন জিনিসের প্রবর্তন করবে, যার ভিত্তি এ দ্বীনে নেই, তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, মুজাহিরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, তালীক্ব ইত্যাদি)
আর এ বিদয়াত সম্পর্কেই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ
অর্থ: প্রত্যেক বিদয়াতই (সাইয়্যিয়াহ) গুমরাহী। (মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী ইত্যাদি)
উল্লেখিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দৃষ্টিতে বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহকে বিদয়াত ফিদদ্বীন বলা হয়। আর এ বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহকেই শরয়ী বিদয়াত বলা হয়।
মূলকথা হলো- যা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর নতুন উদ্ভব হয় এবং তা দ্বীনের সাহায্য করে থাকে অথবা সাহায্যকারী না হলেও দ্বীনের কোন ক্ষতি করে না, তাই বিদয়াত লিদদ্বীন বা লাগউয়ী বিদয়াত অর্থাৎ বিদয়াতে হাসানাহ যা সম্মানিত শরীয়ত উনার মধ্যে গ্রহণযোগ্য।
আর যে নতুন বিষয় উদ্ভব হওয়ার কারণে দ্বীনের কিছুমাত্রও ক্ষতি হয়, তবে তাই হবে বিদয়াত ফিদদ্বীন বা শরয়ী বিদয়াত অর্থাৎ বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ। যা সম্মানিত শরীয়ত উনার মধ্যে গ্রহণযোগ্য নয়।
বিদয়াতে হাসানাহ এর বিশ্লেষণ
নিম্নে বিদয়াতে হাসানাহ ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ্র উদাহরণভিত্তিক ব্যাখ্যা দেয়া হলো-
বিদয়াতে ওয়াজিব: যা পালন না করলে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনাকে পরিপূর্ণভাবে পালন করা ও আমল করা সম্ভব নয়। যেমন পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ কাগজে কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করা, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার যের, যবর, পেশ দেয়া, মাদরাসা নির্মাণ করা, নাহু ছরফ, উছূল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কিতাব লেখা ও পড়া।
বিদয়াতে মুস্তাহাব: যা শরীয়তে নিষেধ নেই এবং তা সমস্ত মুসলমানগণ ভাল মনে করে ছওয়াবের নিয়তে করে থাকেন। যেমন- নিয়মিতভাবে তারাবীহ নামায জামায়াতে পড়া, মুছাফিরখানা, ইবাদতখানা, লঙ্গরখানা, খানকা শরীফ ইত্যাদি জনহিতকর কাজ করা। রমাদ্বান শরীফ মাসে বিতির নামায জামায়াতে আদায় করা ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত- নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
مَا رَأَوْهُ الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنٌ. لَا تَجْتَمِعُ أُمَّتِي عَلَى الضَّلَالَةِ
অর্থ: লোকেরা (মু’মিনগণ) যা ভাল মনে করেন তা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকটেও ভাল। আমার উম্মতগণ কখনো গুমরাহীর মধ্যে একমত হবেন না। (মিশকাত শরীফ)
বিদয়াতে মুবাহ: ঐ সমস্ত নতুন কাজ যা শরীয়তে নিষেধ নেই, যেমন- পোলাও, বিরিয়ানী, বুট, মুড়ি, পিয়াঁজো ইত্যাদি খাদ্য খাওয়া। ট্রেন, মোটরগাড়ী, প্লেন ইত্যাদি যান-বাহনে চড়া। উল্লেখিত বিষয়গুলো মূলত বিদয়াতে হাসানাহর অন্তর্ভুক্ত।
বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ-এর বিশ্লেষণ
বিদয়াতে হারাম: যা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের পরিপন্থী বা ফরয ওয়াজিব আমলগুলি ধ্বংসের কারণ। যেমন- ইয়াহুদী, নাছারা ও ভ- ফকিরদের কু-প্রথা বা বদ আক্বীদাসমূহ।
বিদয়াতে মাকরূহ: যার দ্বারা কোন সুন্নত কাজ বিলুপ্ত হয়ে যায়। যেমন- বিধর্মীদের পোশাক পরিধান করা, টাই পরিধান করা, চেয়ারে বসে নামায পড়া এবং বিধর্মীদের অনুসরণ করা ইত্যাদি।
কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে-
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا أَحْدَثَ قَوْمٌ بِدْعَةً إِلاَّ رُفِعَ مِثْلُهَا مِنَ السُّنَّةِ فَتَمَسُّكٌ بِسُنَّةٍ خَيْرٌ مِّنْ إِحْدَاثِ بِدْعَةٍ.
অর্থ: নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যখনই কোন ক্বওম বা সম্প্রদায় একটি বিদয়াতের প্রচলন করেছে তখনই একটি সুন্নত লোপ পেয়েছে। অতএব উদ্ভাবিত বিদয়াতের পরিবর্তে সুন্নত মুবারক আঁকড়ে ধরা বা পালন করাই তোমাদের জন্য উত্তম অর্থাৎ অপরিহার্য কর্তব্য। (মুসনাদে আহমদ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, মুযাহিরে হক্ব, শরহুত ত্বীবী, তালীক্ব, আশয়াতুল লুময়াত, মিরআতুল মানাযীহ)
বিদয়াতের অনুরূপ ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা নিম্নোক্ত কিতাবসমূহেও রয়েছে। যেমন- বুখারী শরীফ উনার শরাহ ফাতহুল মুবীন, হাশিয়ায়ে মিশকাত শরীফ, আশআতুল লুমআত, ফতওয়ায়ে শামী, ইশবাউল কালাম, তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, হুসনুল মাকাছেদ ইত্যাদি। (সমাপ্ত)
-০-
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সম্পর্কে বাতিল ফিরক্বা কর্তৃক উত্থাপিত সমালোচনা সমূহের দলীলসম্মত জাওয়াব (৩০)
২৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ছবি তোলা হারাম ও নাজায়িজ
২৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
তরজমাতুল মুজাদ্দিদিল আ’যম আলাইহিস সালাম পবিত্র কুরআন শরীফ উনার ছহীহ্ তরজমা
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
পর্দা পালন করা পুরুষ মহিলা সবার জন্য ফরজ
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার দৃষ্টিতে লেবাস বা পোশাকের হুকুম-আহকাম (১)
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ওহাবীদের চক্রান্ত উন্মোচন
২২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ছবি তোলা হারাম ও নাজায়িয
২২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
হালালকে হারাম করা নিষেধ
২২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ শরীয়তসম্মত, নিখুঁত, ব্যবহারে সহজ এবং রহমত, বরকত, সাকীনা লাভের কারণ (৬)
২২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার)