পবিত্র দ্বীন ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা
, ২০ রবীউছ ছানী শরীফ, ১৪৪৫ হিজরী সন, ০৭ সাদিস ১৩৯১ শামসী সন , ০৫ নভেম্বর, ২০২৩ খ্রি:, ২০ কার্তিক, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) পবিত্র দ্বীন শিক্ষা
ক্রিকেট-ফুটবলসহ যাবতীয় খেলাধুলার আবিষ্কার এবং প্র্যাক্টিস এসেছে কাফিরদের কাছ থেকে। যে কাজ বিধর্মীদের সাথে তাশাব্বুহ বা সাদৃশ্য রাখে অথবা দ্বীন ইসলাম থেকে সরিয়ে দেয়, তা সম্পূর্ণ কুফরী।’
আবু দাউদ শরীফের হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ তাহলে বিধর্মীদের আবিষ্কৃত এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায়, তাদের তর্জ-তরীকায় আয়োজিত ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ-উদ্দীপনা প্রকাশ করা কি মুসলমানদের উচিত হবে?
শরীয়তের দৃষ্টিতে খেলাধুলা হারাম হলেও অনেকে বিষয়টি বুঝতে চায় না। খেলাধুলা হারাম না হবার কারণ হিসেবে তারা বিভিন্ন যুক্তি-তর্কের অবতারণা করে থাকে। যেমন:
১. “খেলায় তো শরীর চর্চা হয়, তাহলে এটি হারাম কেন হবে?”
অথচ “যে সমস্ত খেলায় শরীর চর্চা হয়, সে সমস্ত খেলা জায়িয”- এমন বক্তব্যসমৃদ্ধ কোন জাল হাদীছও নেই। বরং হাদীছ শরীফে ৩টি ব্যতিত সকল খেলাকে হারাম করা হয়েছে।
পবিত্র হাদীছ শরীফে খেলাধুলা সম্পর্কে স্পষ্ট বলা আছে- মানুষের প্রত্যেক খেলাধুলা বাতিল, তবে তীর নিক্ষেপ, ঘোড় দৌড় এবং নিজ আহলিয়া বা স্ত্রীর সাথে শরীয়তসম্মত হাসি-খুশি প্রকাশ করা ব্যতীত।” (তিরমিযী শরীফ, ইবনে মাজাহ শরীফ, মুসনাদে আহমদ শরীফ এবং ছহীহ ইবনে খুযাইমা)
এ বিষয়ে হাফিযে হাদীছ, বাহরুল উলূম, মুফতীয়ে আ’যম হযরত মাওলানা মুহম্মদ রুহুল আমীন বশিরহাটি রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ‘ফতওয়ায়ে আমিনিয়া’ কিতাবে বলেছেন, “জায়িয কাজ দ্বারা যখন ব্যায়াম করার উপায় আছে, তখন নাজায়িয কাজের দ্বারা কীরূপে জায়িয হবে? খেলায় প্রতিযোগিতা করলে কী ফল হবে? কিন্তু লাঠি, তীর ছোঁড়া, তরবারী চালনা, ঘোড়-দৌড় ইত্যাদি শত্রুদের হাত থেকে কতকটা নিষ্কৃতির উপায় হতে পারে। পক্ষান্তরে খেলাতে এই প্রকার কোনো লাভ হতে পারে না। বরং ওটা খাঁটি খেলবাজি ভিন্ন আর কিছুই নয়। কাজেই খেলাধুলা কিছুতেই জায়িয হতে পারে না। কেবল দুনিয়াদার স্বার্থপর দু’ একজন নামধারী আলিম খেলাধুলা জায়িয হওয়ার ফতওয়া দিয়েছে। তাদের ফতওয়া কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”
তাছাড়া ক্রিকেটসহ যেকোনো খেলার খেলোয়াড়রা কিন্তু খেলার মাধ্যমে শরীরচর্চা করে না। বরং শরীরচর্চার অন্যসব কসরত করে তারা শরীরকে ফিট রাখে, এবং খেলতে নামে। অর্থাৎ খেলার পূর্বেই তাদেরকে ফিট হয়ে নিতে হয়, তার জন্য শরীরচর্চা করতে হয়। তাছাড়াও খেলায় শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে অনেক সময় ইনজুরী বা আহত হতে হয়। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বলের আঘাতে মৃত্যুর ঘটনাও বহু আছে।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই খেলাধুলায় সামান্য কিছু শারীরিক উপকার আছে, তবু সেটার অন্যান্য অপকার অনেক বেশি বলেই হাদীছ শরীফের মধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঠিক যেমন মদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফে ইরশাদ মুবারক করেছেন, “আয় আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি তাদেরকে জানিয়ে দিন, মদ ও জুয়া এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর এগুলোতে মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে; তবে এগুলোর অপকারিতা, উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বেশী”। (পবিত্র সূরা বাক্বারাহ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২১৯)
এই উদাহরণের মাধ্যমে বোঝা যায় সামান্য পার্থিব স্বার্থ থাকলেও বড় অপকারিতার কারণেই খেলাধুলাকে হারাম করা হয়েছে।
২. অনেকে প্রশ্ন করে থাকে, “নামাযের যদি ক্ষতি না হয়, তবে কি ক্রিকেট খেলা জায়িয?”
এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় যে, ছলাত বা নামাযের ক্ষতির উপর ভিত্তি করে শরীয়তে খেলাধুলাকে জায়িয নাজায়িয করা হয়নি। তবে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বহু লোকের নামায-রোযার বা অন্যান্য নেক আমলের ক্ষতি হয়। অনেকে খেলার মাঠে থেকে নামায পড়তে পারে না। শুধু তাই নয়, নামাযের মধ্যে অনেকে রান-বলের হিসাব-নিকাশ করে, যা নামাযের হুযূরী নষ্ট করে, যা পবিত্র সূরা মাউন অনুসারে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ।
পাঠক! উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যবসায়ী যদি হালাল ব্যবসা করেন, কিন্তু সেই ব্যবসায় অধিক মনোযোগ দিতে গিয়ে নামায মিস করেন, সেক্ষেত্রে কি সেই সম্পূর্ণ ব্যবসাই হারাম হয়ে যাবে এখানে নামাযে ক্ষতি হবার কারণে? কিংবা আরেকজন ব্যবসায়ী, যে হারাম পণ্য বিক্রি করে, কাস্টমারকে ঠকায়; সে যদি ৫ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে মসজিদে গিয়ে আদায় করে; তাহলেই কি তার সেই ব্যবসা ও ইনকাম হালাল হয়ে যাবে? শরীয়ত অনুসারে সেটা কখনোই সম্ভব নয়। বরং, প্রথম ব্যক্তি নামায না পড়ার গুনাহে গুনাহগার হবে, দ্বিতীয় ব্যক্তি হারাম রোজগারের সব ধরনের ফায়সালা ভোগ করবে। অর্থাৎ নামাযের ক্ষতি হবে কি হবে না, সেটার ভিত্তিতে অন্য একটি কাজকে হালাল-হারাম আমরা বলতে পারবো না।
৩. অনেকে বলে থাকে, “ইবাদতের মধ্যে কম বেশি সংযোজন করাকে বিদআত বলে। কিন্তু ক্রিকেট খেলা ইবাদতের অংশ নয়।”
পাঠক, দ্বীন ইসলামে প্রতিটি আমলের আলাদা আলাদা স্বীকৃতি আছে। কোনটা হালাল, কোনটা ফরযে আইন, ফরযে কিফায়া, ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ, সুন্নতে যায়িদাহ, কোনটা হারাম, কোনটা মাকরূহ তাহরীমী, মাকরূহ তানযিহী, বিদআতে হাসানাহ, বিদআতে সাইয়্যিয়াহ, মুবাহ ইত্যাদি। অর্থাৎ সীমারেখার বাইরে কোন আমল নেই। এ সীমারেখা দিয়েই ক্রিকেট খেলার ফায়সালা করতে হবে। কিন্তু ক্রিকেট খেলা ইবাদতের অংশ নয়, এটা দ্বীন ইসলামের কোন নীতি নয়, বরং খৃস্টানদের থেকে আগত সেক্যুলারিজম নীতি, যেখানে দ্বীন ও দুনিয়ার আমলকে পার্থক্য করা হয়েছে।
৪. “কেউ যদি পেশা হিসেবে ক্রিকেট খেলা না নেয়, তবে ক্রিকেট খেলা জায়িয হবে কি?”
উত্তর- উপরোক্ত কথা পবিত্র হাদীছ শরীফের সাথে মিলে না। পবিত্র হাদীছ শরীফে খেলাধুলা সম্পর্কে স্পষ্ট বলা আছে- মানুষের প্রত্যেক খেলাধুলা বাতিল, তবে তীর নিক্ষেপ, ঘোড় দৌড় এবং নিজ আহলিয়া বা স্ত্রীর সাথে শরীয়তসম্মত হাসি-খুশি প্রকাশ করা ব্যতীত।” (তিরমিযী শরীফ, ইবনে মাজাহ শরীফ, মুসনাদে আহমদ শরীফ এবং ছহীহ ইবনে খুযাইমা)
এই হাদীছ শরীফ অনুসারে ক্রিকেট খেলা হারাম হয়। এখানে পেশা গ্রহণ করা কিংবা না করার মধ্যে কোন উছূল নেই।
৫. খেলাধুলার পক্ষের লোকেরা “খেলাধুলা হারাম” বিষয়ক দলিলে না পেরে “মোবাইল ব্যবহার করা, ফেসবুক ব্যবহার করা এগুলোও হারাম, কারণ তা কাফিরের বানানো” এ যুক্তিও নিয়ে আসে। তাদের উত্তরে বলতে হয়, মোবাইল ফোন/ফেসবুক নতুন আবিষ্কার হয়েছে এবং সেগুলোর দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন একাধিক কাজ করা যায়, যার কোনটা হালাল, কোনটা হারাম। মূলতঃ ঐ বস্তু/পণ্যের দ্বারা যে সমস্ত কাজ শরীয়তের খেলাফ হয় সেগুলো হারাম এবং যে কাজগুলো শরীয়তের পক্ষে যায় সেগুলো হালাল। কেউ যদি হারাম এড়িয়ে হালাল কাজে ঐ পণ্য বা বস্তু ব্যবহার করতে পারে, তবে তার জন্য তা হালাল। তবে ফেসবুক-মোবাইল ব্যবহার হারাম কি হালাল সে যুক্তিতে কখনই আরেকটা হারাম হালাল হয়ে যায় না। একজন খুনী খুন করে পার পেয়ে গেলে, আরেকজনের খুন করা বৈধ হয়ে যায় না। বিশেষ করে যেখানে খেলাধুলা সম্পর্কে স্পষ্ট হাদীছ শরীফে আছে, সেই উছূল অনুসারে ক্রিকেট খেলাকে হারাম বলা যায়। নতুন করে যুক্তি বানিয়ে বা অন্য হারামের বহুল ব্যবহারকে দলিল বানিয়ে খেলাধুলাকে জায়িয করার কোনই সুযোগ নেই।
সুতরাং পাঠক, আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, দ্বীন ইসলামের বিধান অনুসারে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা হারাম সেটা বুঝতে পারা, এই বিষয়ক আগ্রহ-উদ্দীপনা থেকে বিরত থাকা এবং অন্যকেও বলা। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন!
-মুহম্মদ মুহিউদ্দিন রাহাত।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
তরজমাতুল মুজাদ্দিদিল আ’যম আলাইহিস সালাম পবিত্র কুরআন শরীফ উনার ছহীহ্ তরজমা
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
পর্দা পালন করা পুরুষ মহিলা সবার জন্য ফরজ
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার দৃষ্টিতে লেবাস বা পোশাকের হুকুম-আহকাম (১)
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ওহাবীদের চক্রান্ত উন্মোচন
২২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ছবি তোলা হারাম ও নাজায়িয
২২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
হালালকে হারাম করা নিষেধ
২২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ শরীয়তসম্মত, নিখুঁত, ব্যবহারে সহজ এবং রহমত, বরকত, সাকীনা লাভের কারণ (৬)
২২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
“আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম” কিতাবের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিরোধিতাকারীদের আপত্তির জবাব
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
পর্দা রক্ষা করা ফরজ, বেপর্দা হওয়া ব্যভিচারের সমতুল্য
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার)