নিকট অতীতে খেজুরের গুড় রপ্তানী হতো। কিন্তু অবহেলায় অনাদরে অনাচারে কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা।
খেজুর গাছ বৃদ্ধিতে অতি সহজে গ্রাম বাংলার সমৃদ্ধি বাড়বে ইনশাআল্লাহ।
, ০৯ রজবুল হারাম শরীফ, ১৪৪৫ হিজরী সন, ২৪ সামিন, ১৩৯১ শামসী সন , ২২ জানুয়ারি, ২০২৪ খ্রি:, ০৭ মাঘ, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) বিশেষ প্রতিবেদন
লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক খেজুর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আর এ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, জাতিসংঘের উদ্যোগে খেজুর উৎপাদন ও উন্নয়নসংক্রান্ত বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বাণিজ্যিক ব্যবহার ও মানদন্ডবিহীন খেজুর তদারকি করবে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মতে বাংলাদেশে প্রায় ৬৮.১০ বর্গকিলোমিটারে খেজুর গাছ জন্মে এবং এই গাছের সংখ্যা ১০ কোটিরও অধিক।
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে খেজুরের গুড় পাওয়া যায়। এক সময় এ খেজুরের রস থেকে চিনি তৈরি করা হতো। বৃহত্তর যশোর ও ফরিদপুর জেলা, নদীয়া জেলার কিছু অংশ, বশিরহাট ও সাতক্ষীরা মহকুমায় এবং চব্বিশ পরগনায় ব্যাপকভাবে খেজুর গাছের চাষ হতো। এখনও এসব এলাকাতেই খেজুরের গুড় বেশি উৎপাদিত হয়। ১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকে চবিবশ পরগনার হাওড়া, মেদিনীপুর এবং ফরিদপুর জেলাগুলিতে এ শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে। তৎকালীন সময়ে প্রতি বছর মোট ১,০০,০০০ টন গুড় উৎপাদিত হতো। ১ বিঘা জমিতে ১০০টি গাছ লাগানো যায়। সাত বছরের মধ্যে গাছগুলি ফল ও রস সংগ্রহের উপযোগী হয় এবং ত্রিশ/চল্লিশ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়।
কয়েক বছর আগেও শীত মৌসুমে খেজুর রসকে ঘিরে গ্রামীণ জনপদে শুরু হতো উৎসবমুখর পরিবেশ। রসের পাশাপাশি হাটবাজারে বিক্রি হতো খেজুর রসের সুস্বাদু ঝোলা ও পাটালি গুড়। প্রতি বছর প্রকৃতিতে শীত জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গে গুড়ের ম-ম গন্ধে ভরপুর থাকত কৃষকের বাড়ির আঙিনাসহ হাটবাজার। এ রস ও গুড় দিয়ে পাড়া-মহল্লায় তৈরি হতো নানা ধরনের পিঠা-পায়েস। দিন দিন এসব স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে।
গাছিরা জানায়, নগদ টাকার লোভে অনেকে ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছ বিক্রি করে। এতে দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোয় ব্যাপক হারে কমেছে খেজুর গাছের সংখ্যা। এছাড়া কনকনে শীতের ভেতর খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করার কষ্ট না করার প্রবণতা, দক্ষ গাছির সংখ্যা কমে যাওয়া, গাছিদের পেশা বদল, খেজুর গাছের পরিবর্তে লাভজনক ফসল আবাদ, বাজারে কম দামে ভেজাল গুড়ের আধিক্য থাকায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খেজুর গুড় উৎপাদন কমছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তারা খেজুরের রস সংগ্রহের আধুনিক পদ্ধতি উদ্ভাবনে গবেষণায় জোর দেয়ার পাশাপাশি খেজুর গাছ রোপণের প্রকল্প গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে।
পাঁচ বছর আগেও নড়াইল জেলায় বাণিজ্যিকভাবে এক হাজার টন খেজুর গুড় ও পাটালি উৎপাদন হলেও বর্তমানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। বর্তমানে এক কেজি খেজুর গুড় ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসেবে পাঁচ বছর আগে নড়াইল জেলা থেকে প্রতি মৌসুমে অন্তত ৩০ কোটি টাকার খেজুর গুড় ও পাটালি বিক্রি হতো। এদিকে খেজুর রস ও গুড়ের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে পথে-প্রান্তরে, মাঠেঘাটে বেশি করে খেজুর গাছ রোপণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন গাছি, পরিবেশবিদ ও প্রকৃতিপ্রেমীরা।
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে এ জেলায় ১০০ হেক্টর জমিতে খেজুর গাছ ছিল। ওই বছর বাণিজ্যিকভাবে ৯১২ টন গুড় উৎপাদন হয়েছিল। বর্তমানে জেলায় কত হেক্টর জমিতে খেজুর গাছ আছে তার কোনো হিসাব দিতে পারেনি কৃষি বিভাগ। এমনকি চলতি মৌসুমে গুড় ও পাটালি উৎপাদনেরও কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি।
লোহাগড়া উপজেলার আমাদা গ্রামের গাছি জামাল শেখ (৫৮) বলেন, একসময় তিনি প্রতি মৌসুমে তিন-সাড়ে ৩০০ খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করতেন। এখন আর আগের মতো যেখানে-সেখানে খেজুর গাছ নেই। এ বছর ৬০টি খেজুর গাছ তুলেছেন (রস উপযোগী) তিনি। কয়েক সপ্তাহ হলো গাছে রস আসতে শুরু করেছে। আগে অনেক রস হতো সেই রস দিয়ে গুড় ও পাটালি বানিয়ে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করতেন তিনি। এখন গাছ কমে গেছে, তাই রসও কম হয়। গত তিন বছর যাবত গুড় বানানোর মতো এত বেশি রস হয় না।
মাগুরা জেলার বিভিন্ন এলাকার গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় গ্রামাঞ্চলে অনেক খেজুর গাছ থাকলেও কালক্রমে সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে বিভিন্ন রকম চাহিদার প্রয়োজনে। জ্বালানি কাঠ ও কয়লার তুলনায় সস্তা হওয়ায় ইটভাটায় বিশেষ চাহিদা রয়েছে খেজুর গাছের। ইটভাটার চাহিদা মেটাতে মাগুরার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অধিকাংশ খেজুর গাছই কাটা পড়েছে। এছাড়া খেজুর রস সংগ্রহ পেশার সঙ্গে জড়িতরা পেশা বদলে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।
মাগুরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ জানায়, মাগুরায় এখনো ৫০ হাজারের অধিক খেজুর গাছ রয়েছে। গাছ বড় হওয়া ও গাছির অভাবে বেশির ভাগ গাছ থেকেই রস সংগ্রহ করা হচ্ছে না।
যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার আট উপজেলায় মোট ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি খেজুর গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫টি গাছে রস হয়ে থাকে, যা থেকে ৫ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ২৫০ লিটার রস পাওয়া যায়। আর গুড় তৈরি হয় ৫২ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৫ কেজি। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ১৩ হাজার ১৭৩ কৃষক পরিবার সম্পৃক্ত।
চুয়াডাঙ্গা জেলায় উৎপাদিত উৎকৃষ্টমানের খেজুরের গুড়ের চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। শীতের চার মাস গাছিরা প্রতিদিন সকালে খেজুর গাছের রস থেকে গুড় তৈরি করে। জেলার চারটি উপজেলায় চলতি মৌসুমে ২ লাখ ১৩ হাজার ১৫০টি খেজুর গাছ থেকে সাড়ে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার ৪৫০ টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
ঝিনাইদহের গাছিরা জানায়, কনকনে শীত উপেক্ষা করে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বাড়িতে আনতে হয়। এরপর গৃহিণীরা অনেক কাঠখড়ি পুড়িয়ে গুড় তৈরি করে। ফলে বর্তমান সময়ে মানুষ আর গুড় তৈরির মতো কঠোর পরিশ্রম করতে চায় না। ফলে দিনে দিনে গাছের সঙ্গে গাছিও কমে যাচ্ছে।
একসময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে খেজুরের গুড় রফতানি হতো। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশি বেশি খেজুর গাছ রোপণ করা প্রয়োজন এবং গাছিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খেজুরের রসের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা দরকার। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা ও কঠোর নজরদারির অভাবে ইটের ভাটায় অবাধে খেজুর গাছসহ ফলবান বৃক্ষ পোড়ানোর কারণে খেজুর বৃক্ষের বিরাট অংশ উজার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় হয়তো খেজুর রসের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। খেজুরের রসের পিঠা পায়েস তখন শুধুই স্মৃতির রোমন্থন হয়ে বেঁচে থাকবে। এজন্য খেজুর গাছ যাতে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে সেজন্য পরিকল্পিত উপায়ে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ গাছের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব, ঐতিহ্য ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ইনশাআল্লাহ।
-আল্লামা মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
ভারতীয় পানি আগ্রাসন, ফারাক্কা ও তিস্তা ব্যারেজ : বাংলাদেশের মরণ ফাঁদ (২)
২৪ আগস্ট, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঘাদানি কমিটির শাহরিয়ার কবিরও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার (৫)
০৭ আগস্ট, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ঘাদানি কমিটির শাহরিয়ার কবিরও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার (৪)
০৬ আগস্ট, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
ঘাদানি কমিটির শাহরিয়ার কবিরও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার (৩)
০৫ আগস্ট, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
ঘাদানি কমিটির শাহরিয়ার কবিরও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার (৩)
০৫ আগস্ট, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
ঘাদানি কমিটির শাহরিয়ার কবিরও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার (২)
০৪ আগস্ট, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ঘাদানি কমিটির শাহরিয়ার কবিরও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার (১)
০৩ আগস্ট, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
উপজাতি-পাহাড়িদের ‘যুদ্ধাপরাধ’ ও ‘রাজাকারগিরি’র উপাখ্যান (পর্ব-৬)
০১ আগস্ট, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
উপজাতি-পাহাড়িদের ‘যুদ্ধাপরাধ’ ও ‘রাজাকারগিরি’র উপাখ্যান (পর্ব-৫)
৩১ জুলাই, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
উপজাতি-পাহাড়িদের ‘যুদ্ধাপরাধ’ ও ‘রাজাকারগিরি’র উপাখ্যান (পর্ব-৪)
৩০ জুলাই, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
উপজাতি-পাহাড়িদের ‘যুদ্ধাপরাধ’ ও ‘রাজাকারগিরি’র উপাখ্যান (পর্ব-৩)
২৯ জুলাই, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
উপজাতি-পাহাড়িদের ‘যুদ্ধাপরাধ’ ও ‘রাজাকারগিরি’র উপাখ্যান (পর্ব-২)
২৮ জুলাই, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার)