ছাগল: ব্ল্যাক বেঙ্গল যেসব কারণে অনন্য
, ১০ মুহররমুল হারাম শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ১৯ ছানী, ১৩৯২ শামসী সন , ১৭ জুলাই, ২০২৪ খ্রি:, ০২ শ্রাবণ, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) পাঁচ মিশালী
পৃথিবীতে এই মুহূর্তে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উপায়ে মডিফায়েড মিলে প্রায় ৩০০’র মত জাতের ছাগল আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্থানীয় জাতের কালো ছাগল বা ব্ল্যাক বেঙ্গলকে অন্যতম সেরা জাতের ছাগল বলা হয়।
গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছে, এ স্বীকৃতি এসেছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র মত সংস্থার গবেষণার মাধ্যমে।
২০০৭ সালে এফএও বিশ্বের ১০০টি জাতের ছাগলের ওপরে গবেষণা চালিয়ে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’কে বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দেখতে কেমন, বৈশিষ্ট্য কী?
বিশ্বে ৩০০ রকমের ছাগলের জাত থাকলেও কিন্তু আকার, আয়তন এবং বৈশিষ্ট্য ভেদে এরা একে অপরের থেকে আলাদা হয়।
২০১৮ সালে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জিনোম সিকোয়েন্সিং বা পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করেছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের একটি দল।
সেই দলের সদস্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক এমএএম ইয়াহিয়া খন্দকার বলেছেন, এই ছাগলের গায়ের রং মূলত কুচকুচে কালো। এটি আকারে বেঁটে, কিন্তু শরীরের কাঠামো শক্তপোক্ত ও পেশীবহুল। এর গায়ের লোম খাটো এবং শিং ছোট হয়।
একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ছাগল বা পাঠার ওজন হয় ২২ থেকে ৩০ কেজি, ছাগীর ওজন ২০ থেকে ২৫ কেজি হয়।
ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল ১৪ মাসে দুইবার বাচ্চা দেয়, প্রতি বারে অন্তত দুইটি, সর্বোচ্চ ৫টি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে একবারে। এই ছাগল দুধ কম দেয়।
বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খ-, আসাম, এবং উত্তর উড়িষ্যায় পাওয়া যায়। এছাড়া মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকাতেও পাওয়া যায় এই জাতের ছাগল।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পরিষ্কার, শুষ্ক এবং উঁচু জায়গায় থাকতে পছন্দ করে।
অধ্যাপক এমএএম ইয়াহিয়া বলেছেন, “বহু বছর ধরে এ অঞ্চলে আবাস হবার কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের জিনগত বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মিশে গেছে, যে কারণে মূলত বাংলাদেশেই তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।”
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এবং ঝিনাইদহ জেলায় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নামটি এলো কোথা থেকে:
ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের এই ছাগলটি বাংলাদেশের একেবারে নিজস্ব প্রজাতি।
গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ অঞ্চলে পশুপালনের একেবারে শুরুর সময় থেকে এ জাতের ছাগল এখানে ছিল। তবে স্থানীয়ভাবে এগুলো দেশী কালো ছাগল বলে পরিচিত ছিল।
কিন্তু যখন থেকে পশুপালন গবেষকেরা এই প্রাণী নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল’ এই নামটি আসে।
পরবর্তীতে যখন আন্তর্জাতিক গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে বাংলাদেশের এই নিজস্ব প্রজাতি, তখন থেকে একে এই নামেই ডাকা শুরু হয়।
কেন ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল অনন্য?
মূলত গোশত ও চামড়ার জন্য এটি বিখ্যাত। গোশত এবং চামড়ার গুনগত মানের জন্য এ জাতের ছাগলকে উৎকৃষ্ট মানের বলা হয়। এছাড়া এটি পালন সহজ এবং পালন করার জন্য বড় কোন জায়গার দরকার হয় না। সংখ্যার দিক থেকে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ এবং ছাগলের গোশত উৎপাদনে পঞ্চম। ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
এছাড়া এ জাতের ছাগলের মধ্যে মৃত্যুহার অনেক কম, এবং ছাগলের বাচ্চার মৃত্যু হারও কম, যেটি এই জাতের ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধি ও জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারণ।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর গড়ে ২ কোটি ২০ লাখ ছাগল উৎপাদন হয়, যার ৯৫ শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল। এর মধ্যে অধিকাংশই কুরবানীর সময় জবাই করা হয়। কুরবানীর সময় দেশে যত গরু জবাই হয়, তার দেড়গুণ ছাগল জবাই হয়। গত পাঁচ বছরে দেশে ছাগল আমদানি করতে হয়নি।
ব্ল্যাক বেঙ্গলের চামড়াও বিশ্বে প্রসিদ্ধ। আন্তর্জাতিক বাজারে ছাগলের চামড়াকে গোটস্কিন ও কিডস্কিন উভয় নামে ডাকা হয়।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া ‘কুষ্টিয়া গ্রেড’ নামে পরিচিত বিশ্ব বাজারে এবং এর কদর আছে।
খামারীদের কাছে চাহিদা বাড়ছে:
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে গবাদি পশুপালনের উৎসাহী হচ্ছেন দেশের অনেক উদ্যোক্তা। তাদের মধ্যে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চাহিদা অনেক। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, এই জাতের ছাগল পালন করা সহজ, এবং এর মৃত্যু হার কম।
বাণিজ্যিক উৎপাদনের কারণে দেশে ব্ল্যাক বেঙ্গলসহ প্রায় সব জাতের ছাগলেরই উৎপাদন বেড়েছে। এক দশক আগেও দেশে দেড় কোটির মত ছাগল উৎপাদন হত। এই মুহূর্তে দেশে প্রায় ৫০ হাজারের মত ছাগলের খামার রয়েছে।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৃদ্ধিতে বাধা:
পৃথিবীর অন্যতম সেরা জাতের ছাগল হবার পরও অনেক সময় খামারিরা এ ছাগল লালন-পালন করতে চান না।
এর একটি কারণ হচ্ছে যেসব এলাকায় এই জাতের ছাগল বেশি হয়, সেখানে মরুকরণের পেছনে এই ছাগলকে অনেকে দায়ী করেন।
এছাড়া ছাগল ফসলের ক্ষেত নষ্ট করে এবং তা থেকে উদ্ভূত আঞ্চলিক মারামারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝিনাইদহ জেলার অন্তত ৩৫টি গ্রামে বেশ কয়েক বছর ছাগল পালন বন্ধ ছিল। তবে এর বাইরেও সমস্যা আছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের জিনের গুনাগুণ, বিশেষ করে প্রজনন ক্ষমতার গুনগত মান হ্রাস পেয়েছে। এর বড় কারণটি হচ্ছে দেশে এই জাতের পাঠার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। গায়ে দুর্গন্ধ হয় বলে লোকে পাঠা পালন করতে চায় না।
এর ফলে পাঠা হিসেবে ছাগলে জন্ম হলেও সেগুলোকে খাসি করে দেয়া হয়। তাছাড়া বাংলাদেশে পাঠার গোশতের চাহিদাও নেই, যে কারণে পাঠার সংখ্যা কম।
অধ্যাপক এমএএম ইয়াহিয়া খন্দকার বলেন, “বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আমরা দেখেছি, একই পাঠা যদি একই পরিবারের কয়েক প্রজন্মের ছাগীর প্রজননের একমাত্র উৎস হয়, অর্থাৎ আন্তঃপ্রজনন হতে থাকে, তাহলে তার জিনের বৈশিষ্ট্যের মান আগের মত থাকবে না।” এই মুহূর্তে দেশে গড়ে ১৬২টি ছাগীর প্রজনন হয় একটি পাঠা দিয়ে।
একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল থেকে কোটিপতি বনে গেছেন নুরুল ইসলাম
একটি ছাগল থেকে একটি-দুইটি করে বাড়তে বাড়তে রীতিমত কোটিপতি বনে গেছেন একসময়ের প্রান্তিক চাষী নুরুল ইসলাম। ২৫ বছর আগে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের একটি ছাগল কেনেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বেতলা গ্রামের নূরুল ইসলাম। সেই একটি ছাগল থেকেই এখন লাখ লাখ টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন তিনি।
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘হাটের থেকে কিনছি ১টা, ১টার থেকে আস্তে আস্তে ২টা, ৩টা- ৪টা- ৫টা এমন হতে হতে এখন আল্লাহ দিলে আমার ৫০ থেকে ৬০টা ছাগল হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘২৫ বছর আমি এই ছাগল লালন-পালন করতেছি, দীর্ঘদিনে আল্লাহ দিলে অনেক কিছু করেছি, কলের লাঙ্গল করেছি, মোটর করেছি, মেশিন করেছি- সব কিছু করেছি, আল্লাহ দিলে আমি ১০-১৫ বিঘা জমিও করেছি, ১০-১৫ লক্ষ টাকা বায়চে আল্লাহর ইচ্ছায়, এই দিয়ে আল্লাহ আমার সংসার চালাচ্ছে। ছাগল থেকে আল্লাহ সব কিছু করাইছে।’
ছাগল পালন শুধু নূরুল নয়, বদলে গেছে পুরো বোতলা গ্রামই। নুরুল ইসলামের দেখাদেখি ছাগল পালনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন আরও অনেকে।
এলাকার একজন বলেন, ‘নূর ইসলাম চাচা ২৫ বছর ধরে ছাগল ব্যবসা করে, তার দেখাদেখি আমরাও ছাগল পালন করতেছি, আর্থিকভাবে আমরাও স্বাবলম্বী। এটা লাভজনক ব্যবসা’।
আবহাওয়ার কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালন সাড়া ফেলেছে পুরো সাতক্ষীরায়। বর্তমানে সাতক্ষীরা সদর উপজেলাতেই রয়েছে প্রায় ১০৮টি ছাগলের খামার। তবে, পশু খাদ্যের দাম লাগামহীন থাকায় বিভিন্ন খোলা-মাঠে এসব পশু পালন করছেন প্রান্তিক এই চাষি। অর্থনৈতিকভাবেও হয়েছেন স্বাবলম্বী।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
বদলে যাচ্ছে রসায়নের শত বছরের পুরনো সূত্র
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
বাতাস থেকে সরাসরি পুষ্টি পেতে পারে মানবদেহ : গবেষণা
২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
উৎপাদন বাড়াতে ছাঁটাই করা হয় চা গাছ
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
সর্দি-কাশি দূর করতে ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে মধুর গুণাগুণ
২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
সর্দি-কাশি দূর করতে ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে মধুর গুণাগুণ
২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
বাংলাদেশের যে গ্রামের জনসংখ্যা চারজন!
২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ডাবের পানি খেলে শরীরে কি হয়? ডাবের পানির উপকারিতা
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
ধানের গোলা এখন কেবলই স্মৃতি
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
১০ হাজার ফুট ওপর থেকেও যেভাবে শিকার দেখতে পায় ঈগল
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
ওজন আর রক্তচাপ কমায় বিটের রস! বাড়ায় স্মৃতিশক্তি
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রবালের সন্ধান মিললো প্রশান্ত মহাসাগরে
১৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
স্ট্রবেরি খেলে শরীরে যা ঘটে
১৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার)