ঐতিহাসিক সম্মানিত বদর জিহাদ (পর্ব-১৩)
, ০৪ যিলক্বদ শরীফ, ১৪৪৪ হিজরী সন, ২৫ ছানী ‘আশার, ১৩৯০ শামসী সন , ২৫ মে, ২০২৩ খ্রি:, ১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) আইন ও জিহাদ
পূর্ব প্রকাশিতের পর
হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার এবং উতবাহ্ ইবনে রবীয়াহ্্ এর প্রচেষ্টা-
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু (তিনি তখনও ঈমান প্রকাশ করেননি) তিনি যখন এরূপ পরিস্থিতির কথা শ্রবণ করে উতবাহ্্ ইবনে রবীয়াহ্র নিকট গেলেন। তখন উতবাহ্্ ইবনে রবীয়াহ্্ যুদ্ধ না করে কুরাইশদেকে বিনাযুদ্ধে ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাবে রাজী হলো। এবং উক্ত প্রস্তাবে আবূ জেহেলকে রাজী করার জন্য, হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে আবূ জেহেলের কাছে পাঠিয়ে দিলো।
হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি এবার উপস্থিত হলেন আবূ জেহেলের কাছে। হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি দেখলেন আবূ জেহেল ভালোভাবে যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত হচ্ছে। হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি আবূ জেহেলকে লক্ষ্য করে বললেন,
“হে আবূল হাকাম (আবূ জেহেলের পূর্ব নাম) উতবাহ্্ ইবনে রবীয়াহ্্ আমাকে তোমার নিকট এ কথাগুলো জানাতে বলেছে।” সবকথা শুনে আবূ জেহেল বললো,
“উতবাহ্্ ইবনে রবীয়াহ্্ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে কোমল দৃষ্টিতে দেখে থাকে। কিন্তু আমি সে রকম নই। কসম! আজ আমি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সঙ্গে চূড়ান্ত ফায়সালা না করে এ স্থান পরিত্যাগ করবো না। নাঊযুবিল্লাহ! নাঊযুবিল্লাহ! নাঊযুবিল্লাহ! উতবাহ্্ ইবনে রবীয়াহ্্ এর পুত্র মহাসম্মানিত মহাপবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেছেন। সে তার পুত্রের নিরাপত্তা চায়। এরপর আবূ জেহেল নিহত আমর হায্্রামীর আত্মীয়দের ডেকে বললো, “তোমরা উতবাহ্্ ইবনে রবীয়াহ্্র প্রতি লক্ষ্য রেখো। সে আমাদের লোকদেরকে নিরুৎসাহিত করে দিতে চায়। তোমরা সকল কুরাইশদেরকে তাদের প্রতিজ্ঞায় অটল থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দাও। আর আজই তোমাদের ভাইয়ের রক্তের বদলা নাও। হে হায্রামী গোত্র! তোমরা সকলকে স্মরণ করিয়ে দাও! কুরাইশ ও হাযরামী গোত্রদ্বয় পরস্পরকে সাহায্য করার ব্যাপারে অঙ্গীকারে আবদ্ধ। আবূ জেহেলের কথা শুনে নিহত আমর হায্রামীর ভাই আমের হায্মী মাথা নিচু করে চিৎকার করে ফরিয়াদ জানাতে থাকলো, “হায় আমর! তোমার রক্তের বদলা কি আমরা নিতে পারবো না।” তার চিৎকার শুনে সকলেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো। যুদ্ধের ব্যাপারে কারো মধ্যে আর কোন মতোবিরোধ রইলো না। পুত্রের প্রতি স্নেহের কারণে উতবাহ্্ ইবনে রবীয়াহ্ যুদ্ধের প্রতি অনীহা ছিলো। কিন্তু সেও মতোবিরোধ না করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। সে ঘোষণা করলো “এখানেই প্রমাণিত হবে কে দুর্বল আর কে সবল। এই বলে সে শিরস্ত্রান চাইলো।” পরপর কয়েকটি শিরস্ত্রান তাকে দেয়া হলো। কিন্তু কোনোটিও তার মাথায় লাগলো না। কারণ তার মাথা অনেক বড় ছিল। কাজেই সে চাদর দিয়ে তার মাথা জড়িয়ে নিলো। আবূ জেহেলও তার তরবারী কোষমুক্ত করলো এবং তার ঘোড়ার পশ্চাৎদেশে আঘাত করলো। এ দৃশ্য দেখে ইমা ইবনে রিহ্দাহ্্ বলে উঠলো, এটাতো দেখছি বড়ই বেয়াড়া।
যেমন এ প্রসঙ্গে তাফসীর ও সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ আছে-
قَالَ حَضْرَتْ حَكِيمٌ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ : فَانْطَلَقْتُ حَتَّى جِئْتُ أَبَا جَهْلٍ، فَوَجَدْتُهُ قَدْ نَثَلَ درعا فَهُوَ يُهَنِّئُهَا (২) فَقُلْتُ لَهُ: يَا أَبَا الْحَكَمِ إِنَّ عُتْبَةَ أَرْسَلَنِي إِلَيْكَ بِكَذَا وَكَذَا. فَقَالَ: انْتَفَخَ وَاللَّهِ سِحْرُهُ (৩) حِينَ رَأَى حَضْرَتْ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَصْحَابَهُ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُم ، فَلَا وَاللَّهِ لَا نَرْجِعُ حَتَّى يَحْكُمَ اللَّهُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ حَضْرَتْ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَمَا بِعُتْبَةَ مَا قَالَ، وَلَكِنَّهُ رَأَى حَضْرَتْ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَصْحَابَهُ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُم أَكَلَةَ جَزُورٍ، وَفِيهِمُ ابْنُهُ، فَقَدْ تَخَوَّفَكُمْ عَلَيْهِ. ثُمَّ بَعَثَ إِلَى عَامِرِ بْنِ الْحَضْرَمِيِّ، فَقَالَ: هَذَا حَلِيفُكَ يُرِيدُ أَن يرجع النَّاس، وَقد رَأَيْتُ ثَأْرَكَ بِعَيْنِكَ فَقُمْ فَانْشُدْ خُفْرَتَكَ وَمَقْتَلَ أَخِيكَ. فَقَامَ عَامِرُ بْنُ الْحَضْرَمِيِّ فَاكْتَشَفَ ثُمَّ صَرَخَ: وَاعَمْرَاهُ وَاعَمْرَاهُ. قَالَ: فَحَمِيَتِ الْحَرْبُ وَحَقِبَ أَمْرُ النَّاسِ وَاسْتَوْثَقُوا عَلَى مَا هُمْ عَلَيْهِ مِنَ الشَّرِّ، وَأَفْسَدَ عَلَى النَّاسِ الرَّأْيَ الَّذِي دَعَاهُمْ إِلَيْهِ عُتْبَةُ. فَلَمَّا بَلَغَ عُتْبَةُ قَوْلَ أَبِي جَهْلٍ: انْتَفَخَ وَاللَّهِ سِحْرُهُ، قَالَ: سَيَعْلَمُ مُصَفِّرُ اسْتِهِ (৪) مَنِ انْتَفَخَ سِحْرُهُ أَنَا أَمْ هُوَ! ثُمَّ الْتَمَسَ عُتْبَةُ بَيْضَةً لِيُدْخِلَهَا فِي رَأْسِهِ، فَمَا وَجَدَ فِي الْجَيْشِ بَيْضَةً تَسَعَهُ مِنْ عِظَمِ رَأْسِهِ، فَلَمَّا رَأَى ذَلِكَ اعْتَجَرَ عَلَى رَأْسِهِ بِبُرْدٍ لَهُ.
অর্থ: “হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, “এবার আমি কাট্টা কাফির আবূ জেহেলের কাছে গেলাম এবং দেখলাম সে তার বর্ম সিন্দুক থেকে বের করে পরিষ্কার করছে।” তিনি আবূ জেহেলকে বললেন, “হে আবূল হাকাম! (অর্থাৎ আবূ জেহেল!) উতবাহ্্ আমাকে তোমার নিকট পাঠিয়েছে।” এরপর উতবাহ্্ আমাকে যা বলেছিলো তা তাকে জানালাম। কাট্টা কাফির আবূ জেহেল বললো, “ক্বসম! উতবাহ্্র মাথা তখন থেকে খারাপ হয়ে গেছে যখন সে মহাসম্মানিত মহাপবিত্র হাবীব মাহবূব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে এবং উনার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে দেখেছে। ক্বসম! কখনো এটা হতে পারে না। যতক্ষণ খ¦লিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের এবং মহাসম্মানিত মহাপবিত্র হাবীব মাহবূব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালা না করে দেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। উতবা যা বলেছে ওটা তার মনের কথা নয়। আসল ব্যাপার হলো, যেহেতু মহাসম্মানিত মহাপবিত্র হাবীব মাহবূব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এবং উনার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা সংখ্যায় কম। আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের ভিতরে তার ছেলেও রয়েছেন। যুদ্ধ হলে তার ছেলে শহীদ হবেন ভেবে সে এ কথা বলেছে।”
এরপর আবূ জেহেল নিহত আমর ইবনে হায্রামীর ভাই আমির ইবনে হায্রামীর কাছে খবর পাঠালো যে, “তোমার মিত্র উতবাহ্্ কুরাইশ বাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। অথচ তোমার ভাইয়ের হত্যার বদলার ব্যাপারটা তোমার নাগালের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং তুমি উঠ এবং তোমার ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিশ্রুতির কথা কুরাইশ বাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দাও। সবাইকে উত্তেজিত করো।” আমির ইবনে হাযরামী উঠে দাঁড়ালো এবং তার ভাইয়ের হত্যার ঘটনা বর্ণনা করার পর সে “হায় আমর! হায় আমর!” বলে চীৎকার করতে লাগলো।
সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের উত্তেজনা সৃষ্টি হলো, ফিরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেলো এবং সন্ধির সমস্ত রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেল। তারা যে যুদ্ধের অভিপ্রায়ে পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে বের হয়েছিল তার জন্য তারা সবাই প্রস্তুত হয়ে গেল। ফলে উতবাহ্্ যে শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল সে তা নস্যাৎ করে দিলো।
উতবাহ্্ যখন আবূ জাহিলের এ উক্তি শুনলো যে, উতবাহ্্র মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তখন সে বললো “অচিরেই সে আমাকে জানতে পারবে আমার মাথা খারাপ হয়েছে না তার মাথা খারাপ হয়েছে।”
এই বলে সে শিরস্ত্রান চাইলো। পরপর কয়েকটি শিরস্ত্রান তাকে দেয়া হলো। কিন্তু কোনোটিও তার মাথায় লাগলো না। কারণ তার মাথা অনেক বড় ছিল। কাজেই সে চাদর দিয়ে তার মাথা বেঁধে নিলো।” (সীরাত ইবনে হিশাম জিল্দ-২ পৃষ্ঠা- ২৮২-২৮৩, আল বিদায়াহ্্ ওয়ান নিহায়াহ্, তারিখুল উমামে ওয়াল মুলূক, সীরাত ইবনে কাছীর, উয়ূনুল আছার ফি ফুয়ূনুল মাগাযী)
-আল্লামা মুহম্মদ জাহাঙ্গীর হুসাইন
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
প্রসঙ্গ: মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মদীনা শরীফ উনার সনদ (৮)
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
৬০ জন সম্মানিত মুসলিম বীর মুজাহিদ উনারা সম্মানিত জিহাদ করলেন ৬০ হাজার কাফিরের বিরুদ্ধে (৬)
১৬ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
প্রসঙ্গ: মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মদীনা শরীফ উনার সনদ (৭)
১১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
৬০ জন সম্মানিত মুসলিম বীর মুজাহিদ উনারা সম্মানিত জিহাদ করলেন ৬০ হাজার কাফিরের বিরুদ্ধে (৫)
০৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
প্রসঙ্গ: মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মদীনা শরীফ উনার সনদ (৬)
০৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
৬০ জন সম্মানিত মুসলিম বীর মুজাহিদ উনারা সম্মানিত জিহাদ করলেন ৬০ হাজার কাফিরের বিরুদ্ধে (৪)
০২ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
৬০ জন সম্মানিত মুসলিম বীর মুজাহিদ উনারা সম্মানিত জিহাদ করলেন ৬০ হাজার কাফিরের বিরুদ্ধে (৩)
২৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
৬০ জন সম্মানিত মুসলিম বীর মুজাহিদ উনারা সম্মানিত জিহাদ করলেন ৬০ হাজার কাফিরের বিরুদ্ধে (২)
২৩ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মক্কা শরীফ বিজয় (১১)
১৯ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
৬০ জন সম্মানিত মুসলিম বীর মুজাহিদ উনারা সম্মানিত জিহাদ করলেন ৬০ হাজার কাফিরের বিরুদ্ধে (১)
১৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মক্কা শরীফ বিজয় (১০)
১৩ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
প্রসঙ্গ: মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মদীনা শরীফ উনার সনদ (৩)
১২ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)