মিশরে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও তৎপরবর্তী ইতিহাস
, ২৩ মুহররমুল হারাম শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ০১ ছালিছ, ১৩৯২ শামসী সন , ৩০ জুলাই, ২০২৪ খ্রি:, ১৫ শ্রাবণ, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) ইতিহাস
৬৪২ খ্রিস্টাব্দে সাইয়্যিদুনা হযরত ফারুকে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার মুবারক খিলাফতকালে সাইয়্যিদুনা হযরত আমর বিন আস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সেনাপতিত্বে আরব মুসলমানরা মিশর বিজয় করেন। মিসরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নীলনদের প্রতি সাইয়্যিদুনা হযরত ফারুকে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার মুবারক নির্দেশ এই সময়ই অনুষ্ঠিত হয়। যার কারণে তখন থেকেই কাফিরদের কু-প্রথা নীলনদে বলিদানের মত কুফরী রেওয়াজ রহিত হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ! যা সাইয়্যিদুনা হযরত ফারুকে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার বেমেছাল রোব মুবারক উনার বহিঃপ্রকাশ।
সেই সময় থেকেই মিশর একটি আরব ভূমিতে রূপান্তরিত হয়। মিশরের অধিবাসীরা ধীরে ধীরে খ্রিস্টধর্ম থেকে দ্বীন ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকে। এর পরবর্তীতে শতাব্দীকাল পরে মিশর উমায়িদ ও আব্বাসিদের রাজবংশের অধীনে ছিল।
১১শ খ্রিস্টাব্দের দিকে সুলতান হযরত সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শাসনকালে ক্রুসেড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই সময় তিনি মিশরের গর্ভনর ছিলেন। পরবর্তীতে নামধারী খলীফার মসনদে গদীনসীন, জুমুয়ার খুতবায় খলীফার নাম উচ্চারণ, ক্ষমতার লিপ্সা, মুসলমানদের কঠিন দুরবস্থা ও চারদিক থেকে কাফিরদের ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি নিজ কাঁধে দায়িত্বভার তুলে নেন। উনার শাসনকালের পর ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি উসমানীয় সাম্রাজ্য মিশরের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়।
১৭৯৮ সালে ফ্রান্সের সেনাপতি নেপোলিয়ন মিশর আক্রমণ করে, কিন্তু উসমানীয় সাম্রাজ্য দ্রুত ক্ষমতা ফিরে পেতে সক্ষম হয়। উসমানীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা মুহম্মদ আলিকে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে মিশরের প্রশাসক বানানো হয়। তিনি দেশটির আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে বেশ কিছু সংস্কার করেন। আলির মৃত্যুর পরে তার পরিবারের সদস্যরা প্রায় ১০০ বছর ধরে মিশরের শাসনভার নিজেদের হাতে রেখে দেন।
১৮৫৯ থেকে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে একটি ফরাসি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে সুয়েজ খাল তৈরি করার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৮৮২ সালে ব্রিটিশ নৌদস্যুরা মিশর দখলে নিয়ে নেয় এবং ১৯১৪ সালে দেশটিকে যুক্তরাজ্যের উপর নির্ভরশীল একটি অঞ্চলে পরিণত হয়।
১৯২২ সালে মিশর নামমাত্র স্বাধীনতা লাভ করে এবং এটিকে একটি সংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিণত করা হয়। কিন্তু এতে ব্রিটিশ দখলদার সেনা উপস্থিতি অব্যাহত থাকে। ১৯৪০-এর দশকে দেশটি আরব লিগ নামের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে, যাতে একাধিক আরব রাষ্ট্র সহযোগিতার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়।
আরব লিগ মিশরের প্রতিবেশী অঞ্চল ফিলিস্তিনের স্থানীয় আরব জনগণ ও সম্প্রতি ইউরোপ থেকে বহিরাগত ইহুদীদের মধ্যবর্তী ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে দখলদার ইহুদীরা ফিলিস্তিনের একটি অংশকে ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে জোরপূর্বক ঘোষণা করলে মিশর ও তার আরব মিত্ররাষ্ট্রগুলি ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। শুরুতে বিজয়ের দারপ্রান্তে থাকলেও মুসলমানদের মধ্য থেকে একদল মুনাফিক ইহুদীদেরকে সহযোগিতা করে। ফলে আরব দেশগুলো ইসরাইলী দখলদারিত্ব থামাতে ব্যর্থ হয়।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে একটি সামরিক দল মিশরের রাজা ফারুককে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে নির্বাসনে পাঠায়, ব্রিটিশ সেনাদের দেশ থেকে উৎখাত করে এবং তাদের নেতা জামাল আবদেল নাসের প্রায় ২০০০ বছর পরে প্রথম স্থানীয় মিশরীয় হিসেবে দেশটির শাসনক্ষমতার অধিকারী হন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে মিশর একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। নাসের মিশরকে আরব বিশ্বের নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালে মিশর ও সিরিয়া একত্রে মিলে একীভূত আরব প্রজাতন্ত্র নামের একটি রাষ্ট্র গঠন করেছিল, কিন্তু সেটি টেকেনি। নাসের আরব সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে অনেক শিল্প কারখানা ও সুয়েজ খালের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ সম্পন্ন করেন। তার শাসনামলে মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে আরও দুইবার (১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালে) যুদ্ধ হয়।
১৯৭০ সালে আনওয়ার এল-সাদাত মিশরের রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৩ সালে মিশর ইসরায়েলের সাথে আরেকটি স্বল্পমেয়াদী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি সাদাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাকেম বেগিনের সাথে বৈঠক করে। এই বৈঠকের সূত্র ধরে ১৯৭৯ সালে মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে এক তথাকথিত শান্তিচুক্তি (ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি) সম্পাদিত হয়। মিশর গাজা উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় ও ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
বেশিরভাগ আরব রাষ্ট্রই এই চুক্তির ব্যাপারে নারাজ ছিল। ১৯৮১ সালে ইহুদী চরমপন্থীরাই সাদাতকে হত্যা করে। নতুন রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারকের নেতৃত্বে মিশরের সাথে অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। তবে মিশর ১৯৯১ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে সম্মিলিত জোটের অংশ হিসেবে ১ম পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
“আরব বসন্ত” পর্বে এসে একটি গণঅভ্যুত্থানে মুবারকের সেনা-সমর্থিত শাসনের অবসান ঘটে এবং নির্বাচনে ইখওয়ানুল মুসলিমীন তথা মুসলিম ব্রাদারহুড নামক ইসলামপন্থী দলের জয় হয়, কিন্তু তাদেরকেও কিছুদিন পরে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। বর্তমানে সেখানে অভ্যুত্থানকারী সেনাশাসক সিসি’র দ্বারা উগ্রবাদের উত্থান ঘটেছে এবং এতে স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে বহু শতাব্দী যাবৎ বিদ্যমান সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কে চিড় ধরেছে।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
ঐতিহাসিক হেজাজ রেলওয়ে” যে রেলপথকে বলা হয় ‘বিশ্বের সব মুসলমানের সম্পত্তি’
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
মুসলমানগণই আধুনিক কাগজ শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা
১৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
ইতিহাস চর্চা ও সংরক্ষণে মুসলমানদের অবদান
১০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি
০৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
মুসলিম সোনালী যুগের পাঠাগার
০৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
আগলাবী সালতানাতের মুসলিম নৌবহর (১)
৩১ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
কায়রোর ঐতিহাসিক আল আযহার জামে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়
২৯ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
স্বর্ণালী যুগে মুসলমানদের বিজয় রহস্য এবং বিধর্মীদের স্বীকারোক্তি (১)
২৯ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
পারস্যের এক গভর্নরের সম্মানিত দ্বীন ইসলাম গ্রহণের ঘটনা
২৩ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পবিত্র আযানের জন্য ২২ জন মুসলমানের শহীদ হওয়ার ঈমানদীপ্ত ঘটনা
১২ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সুলতান আব্দুল হামিদ ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ইহুদীবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্ততা (বিস্তারিত)
০৯ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
যুগে যুগে পবিত্র সাইয়্যিদু সাইয়্যিদিল আ’ইয়াদ শরীফ পালনের ইতিহাস (২)
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)