পতিতালয়, নারী পাচার ও অপহরণের নেপথ্যের কারণ উদঘাটন ও বিশ্লেষণ এবং তা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে: পর্ব-১
, ১৩ শা’বান শরীফ, ১৪৪৪ হিজরী সন, ০৬ ‘আশির, ১৩৯০ শামসী সন , ০৬ মার্চ, ২০২৩ খ্রি:, ২০ ফাল্গুন, ১৪২৯ ফসলী সন, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) মহিলাদের পাতা
পতিতালয় নারী নিপীড়নের একটি জঘণ্য কারখানা। এটা এমন একটা জায়গা যেখানকার প্রত্যেকটা মেয়েকেই তাদের অনিচ্ছায় এই পেশায় নিযুক্ত হতে বাধ্য করা হয়েছে। সমাজে পতিতালয় অবস্থান থাকার কারণেই নিরীহ-নিরপরাধ সহজ-সরল অনেক মেয়ের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। তাদের জীবনটা হয়ে যায় অভিশপ্ত। যেই অভিশপ্ত জগৎ থেকে তারা কোনো দিন আর ফিরে আসতে পারে না সভ্য সমাজে, আপন পরিবারে। জীবনের সকল স্বপ্ন-সাধ-আসা-আকাঙ্খা পরিবার-সংসার সবই শেষ হয়ে যায় এখানেই।
বিভিন্ন গবেষণা, জরিপ ও তথ্য-উপাত্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- বিশ্বে নারী পাচার ও নারী অপহরণের প্রধান কারণ পতিতাবৃত্তি ও পতিতালয়। কারণ দেশে যত নারী অপহরণ ও পাচার হচ্ছে তাদেরকে দেশ-বিদেশের কোনো না কোনো পতিতালয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে নারী অপহরণকারী ও নারী পাচারকারী চক্ররা। যার ফলে অপহৃত প্রায় প্রত্যেকটা মেয়ের বাকী জীবনটা কাটে নিষিদ্ধ পতিতালয়ের অন্ধকার জগতে। যদি এসব পতিতালয় না থাকতো তাহলে নারী পাচার প্রায় বন্ধ হয়ে যেত। কারণ যেই লোভে পাচারচক্র মেয়েদের পাচার করে থাকে তাদের সেই লোভ মিটিয়ে থাকে পতিতালয়ের মাসী-পিসীরা। তাহলে পতিতালয়েই যদি না থাকে তাহলে মেয়েদের পাচার করে নিবে কোথায়? অর্থাৎ পতিতালয় নিষিদ্ধ করা হলে দেশের অনেকগুলো বড় বড় অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারী পাচার।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত যৌনকর্মীদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, তারা কোনো একটি চক্র কর্তৃক প্রতারিত হয়ে অথবা অপহৃত হয়ে পতিতালয়ে বিক্রি হয়ে থাকে। এরপর তাদের উপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। কারণ মেয়েগুলো নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার জগত থেকে বের হতে চায়। কিন্তু ঐ পল্লির পরিচারিকা তাদের অন্ধকার জগত থেকে আর বের হওয়ার সুযোগ দেয় না। এভাবেই শুরু হয় তাদের অন্ধকার জগতের শুরুটা।
তাদের অধিকাংশরাই জানিয়েছে- তারা কখনও চিন্তাও করেনি যে, তাদের জীবনটা এমন অভিশপ্ত ও যন্ত্রনাদগ্ধ নিষিদ্ধ পল্লিতে কাটবে। তাদের জীবনের এমন কালো অধ্যায় শুরু হওয়ার পূর্বে তারাও স্বপ্ন দেখতো একজন ভাল মানুষ হওয়ার, ভাল কিছু করার। কিন্তু পতিতালয় নামক অভিশপ্ত ও অন্ধকার এই জগতটি তাদের জীবন ও স্বপ্ন সব কিছুই শেষ করে দেয়। এমনকি অনেক লোভী স্বামীরা পর্যন্ত টাকার লোভে এসব নিষিদ্ধ পল্লীতে তাদের স্ত্রীদের বিক্রি করে দিচ্ছে। কয়েকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে যে কীভাবে পাচারকারী ও পতিতালয় মেয়েদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।
২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলা পাচার হওয়া একটি মেয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। সাক্ষাৎকারটি নিম্নরূপ -
পাচারের শিকার হয়ে স্থায়ী পতিতা হয়ে যাওয়া একজন জানায়, পরীক্ষায় পাশ করে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ালেখা শুরুর যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন এক মহিলা তাকে ফরিদপুরের একটি পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়।
পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে ওই পতিতা বলে, নিজের ইচ্ছায় কেউ এ জায়গায় আসে না। সবাই পাচারের শিকার। তবে অন্য পল্লী থেকে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পাড়া বদল করে থাকে।
জানা যায়- দালালরা সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকায় মেয়েদের পতিতালয়ে সর্দারনীর কাছে বিক্রি করে। পাচার হয়ে কেউ এ পাড়ায় ঢুকে গেলে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। পাচার হয়ে আসার পর পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া ওই কর্মী বলে, “গোসল করতে গেলেও লোক দাঁড়ানো থাকবে সাথে, টয়লেটে গেলেও লোক থাকবে সাথে। পালানোর কোনো কায়দাই নাই। রাত্রে আবার রুমে দিয়ে তালা লাগায় দেয় বাইরে থেইকা।” একটা পর্যায়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হলেও তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।
ঘৃণ্য ও অবৈধ এই পেশার মাধ্যমে কোনো যৌনকর্মীরই সংসার চলে না, বরং দালালরাই ফায়দা লুটে এরও অনেক প্রমাণ রয়েছে।
এ বিষয়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারির ২৪ তারিখে জার্মানভিত্তিক নিউজপোর্টাল ‘ডয়চে ভেলে’ শাহনাজ বেগম নামক যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা একজন সাবেক যৌনকর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। একটি প্রশ্নের জবাবে সাবেক ওই যৌনকর্মী জানায়-
“...আসলে কেউই নিজের ইচ্ছায় এই পেশায় আসতে চায় না। বাংলাদেশ একটা ‘মুসলিম কান্ট্রি'। তাই ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা শিক্ষা পায় নামাজ পড়ো, রোজা করো, সতীত্ব ধরে রাখো। কারণ তারা শেখে যে সতিত্বই সবচেয়ে বড় সম্বল। তাই টাকার বিনিময়ে কেউই এটা বিক্রি করতে চায় না। কিন্তু মেয়েদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তাদের এখানে আসতে হয়। বেশির ভাগ মেয়েই অভাব-অনটন থেকে বা আঘাত পেয়েই এই পেশায় আসে। তারপর এখানে এসে ওরা যে টাকাটা আয় করে, সেটার একটা বড় ভাগ দালালরা নিয়ে যায়। সংসার চালাতে পারে শতকরা দু-একজন। এই পেশাটা তো বৈধ না, সে কারণে সবাই এদের ওপর মাতবরি করে। এমনকি রাস্তার টোকাইও সেক্স ওয়ার্কারদের মারধর করে তাদের টাকা কেড়ে নেয়।”
বাংলাদেশ ছাড়াও পার্শবর্তী ভারতের পতিতালয়গুলোও বাংলাদেশ থেকে নারী পাচার হওয়ার অন্যতম একটা কারণ।
দৈনিক যুগান্তরে ২০১৫ সালের ১১ জুলাই একটি রিপের্ট প্রকাশ করে। এতে ভারতের পতিতালয় থেকে উদ্ধার হয়ে ফিরে আসা ৭৪ জন তরুনীর দু’জনের লোমহর্ষক কাহিনী প্রকাশ করে। রিপোর্টে বলা হয়-
“... একপর্যায়ে সাহস জোগালে খুলনার তরুণী রুবিনা (ছদ্মনাম) বলে ওঠে, কাউকে ভাই ডাকতেও এখন ভয় লাগে। আমরা চার বোন। ভাই নেই, তাই রুবেলকে (দালাল) বিশ্বাস করে ভাই ডেকেছিলাম, সেই রুবেলই আমার সর্বনাশ করেছে। আমাকে ভারতে পতিতালয়ে বিক্রি করে দিল। এ কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন ওই তরুণী। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাইটস যশোর কার্যালয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
পরিবারের দুর্দশার বর্ণনা করে রুবিনা বলেন, চার বোন ও মাকে ফেলে রেখে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে ঢাকায় সংসার করছেন। আমাদের কোনো খোঁজ নেন না। সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখছি মা মজুরের কাজ করে সংসার চালান। বড় মেয়ে হিসেবে আমি খুব কষ্ট পেতাম। মনে মনে চাকরি খুঁজছিলাম। একপর্যায়ে বান্ধবীর স্বামী রুবেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাকে ভাই ডাকি। তাকেই বলেছিলাম ভাই সংসারে মেলা অভাব, একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। রুবেল বলেছিল, ভারতে ভালো চাকরি আছে। বাসাবাড়িতে কাজ করবি, বেতনও পাবি মেলা টাকা। রুবেলের কথায় বিশ্বাস করে চাকরির লোভে মাকে না জানিয়ে বাড়ি ছাড়ি। রুবেল আমাকে বেনাপোলের পুটখালি সীমান্ত দিয়ে ভারতে দিল্লি নিয়ে এক দেহ ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়। এরপর ওই ব্যবসায়ী আরেকজনের কাছে আমাকে বিক্রি করে দেয়। এরপর দেখি একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে একগাদা মেয়ে। সেখানে আমাকে রাখা হয়। আমি খুব কেঁদেছিলাম। একটা মেয়ে এসে বলল কিছু করার নেই। তুই বিক্রি হয়ে গেছিস। (চলবে)
-মুহম্মদ জিয়াউল হক্ব আকন্দ।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
প্রসঙ্গ মহিলা জামাত নাজায়িজ
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
শৈশবকাল থেকেই সন্তানকে দ্বীনদার হওয়ার শিক্ষা দান করতে হবে
২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
সম্মানিতা মহিলা আউলিয়া-ই কিরাম উনাদের পরিচিতি
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
স্বচক্ষে দেখা কিছু কথা
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
পারিবারিক তা’লীমের গুরুত্ব ও তারতীব
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
সুন্নতী খাবার সম্পর্কিত হাদীছ শরীফ : মেথি
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
খাবার বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
জন্মের প্রথম মাস
১৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের অনুসরণে মু’মীনদের জীবন গড়ে তোলা দায়িত্ব-কর্তব্য
১৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
হযরত উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের বেমেছাল দানশীলতা মুবারক (৩)
১৬ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
নারীবাদী বলে কথা........
১৫ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার)