পতিতালয়, নারী পাচার ও অপহরণের নেপথ্যের কারণ উদঘাটন ও বিশ্লেষণ এবং তা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে: পর্ব-২
, ১৩ মার্চ, ২০২৩ ১২:০০:০০ এএম ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) মহিলাদের পাতা
পতিতালয়ে নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে রুবিনা বলেন, দিল্লির একটা পতিতালয়ে ছিলাম ছয় মাস। সেখানে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। সেখানে এক খদ্দেরের (কলকাতার ছেলে) সঙ্গে ভাব জমিয়ে তুলি। তাকে বলেছিলাম আমাকে বাঁচান। আমি দেশে ফিরে যাব। ওই ছেলেটির কথা মতো একদিন খুব সকালে পতিতালয় থেকে পালাই। ওই ছেলেটি আমাকে বোম্বের ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। বোম্বে স্টেশনে আসার পর একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে আমাকে খুব আদর-যতœ করে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি ওই মেয়েটিও ছিল দালাল। ওই মেয়েটি আমাকে পুনে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। সেখানে ছয় মাস থাকার পর রেস্কি ফাউন্ডেশন আমাকে উদ্ধার করে। রেস্কি ফাউন্ডেশনে দুই বছর থেকেছি। ওই সংগঠনের কার্যালয়ে আমার মতো উদ্ধার হওয়া মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমি বিউটি পার্লার আর সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সব মিলিয়ে তিন বছর ভারতে দুর্বিষহ জীবনযাপন করে দেশে ফিরেছি।
রুবিনার মতো ঢাকার মেয়ে মাহীর (ছদ্মনাম) পাড়ার একটি মেসের এক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। মাহী জানান, পরিচয়ের সুবাধে ফরিদপুরের ওই ভাইয়ের কাছে পার্টটাইম চাকরি চেয়েছিলেন। ওই ভাই তাকে কম্পিউটার কম্পোজের চাকরি দিতে চেয়েছিল। চাকরির প্রলোভনে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো একদিন দুপুরে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বের হই। ওই যুবক তাকে শ্যামলী নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাসে তোলে। এরপর পানীয়ের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে বেনাপোলে নিয়ে যায়। এরপর পুটখালি সীমান্তে এক দালালের বাড়িতে রেখে ভারতে পাচার করে দেয়। এরপর পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ শহরের একটি বাড়িতে রাখা হয় মাহীকে। সেখানে দুদিন রাখার পর বোম্বের পুনে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। সেখানে খদ্দের ও দালালদের নির্যাতনের শিকার হন মাহী। একপর্যায়ে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই একটি এনজিও পতিতালয় থেকে তাকে উদ্ধার করে। উদ্ধারের পর এনজিও তাকে প্রশিক্ষণ দেয়। সর্বশেষ ৩ জুলাই পাচার হওয়া ৭৪ বাংলাদেশী দেশে ফিরে আসে।...”
শুধু রুবিনা কিংবা মাহী নয়, তাদের মতো শত শত তরুণী চাকরির প্রলোভনে ভারতে পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী, বন্ধু ও স্বজনের মতো মুখোশধারীদের দ্বারা। বিক্রির পর তাদের পতিতালয়ে যৌন ব্যবসায় নিয়োজিত করা হচ্ছে।
এমনকি অনেক লোভী স্বামীরা পর্যন্ত টাকার লোভে এসব নিষিদ্ধ পল্লীতে তাদের স্ত্রীদের বিক্রি করে দিচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত- মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কর্ণপাড়া এলাকার বাসিন্দা এক নারীকে এক বছর আগে ভারতের বিহারের একটি পতিতালয়ে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয় তার স্বামী নিখিল। সেখানে তাকে দিয়ে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, অশ্লীল ভিডিও এবং পর্নো ছবি তৈরি করা হতো। সুযোগ পেয়ে ছয় মাস পর ওই নারী সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। পরে র্যাব নীলকান্ত বেপারীর ছেলে ওই নিখিল বেপারীকে গ্রেপ্তার করে। (সূত্র: বার্তা বাজার, মে ১১, ২০১৮)
এভাবে কত মেয়ে যে পাচার হয় এর নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী- বিশ্বে পাচার হওয়া এই তরুণীদের ৩৪ শতাংশ নারী নিজ দেশেই পাচার হয়। আর ৩৭ শতাংশ আন্তঃসীমান্ত পাচারের শিকার। অন্যদিকে, সেইভ দ্য চিলড্রেনের ২০১৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী পূর্ববর্তী ৫ বছরে বাংলাদেশের ৫ লাখ নারী বিদেশে পাচার হয়েছে। যাদের গন্তব্য ভারত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। (সূত্র: বিবিসি বাংলা- ৮-ই ডিসেম্বর, ২০১৬)
এরকম বহু ঘটনা রয়েছে যা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। এখানে নারী পাচার হওয়ার মূল যে কারণ সেটি হচ্ছে পতিতালয় এবং দেহ ব্যবসা। কারণ নারী পাচার সম্পর্কিত উপরের প্রত্যেকটি ঘটনার জন্য দেহ ব্যবসা বা পতিতালয়-ই দায়ী। নারী পাচার এবং পতিতালয় একই সূত্রে গাথা। মূলত নারী পাচারকারী দালালদের সাথে পতিতালয়ের সর্দারনীদের সাথে কন্টাক্ট থাকে। এই কন্টাক্ট সরাসরি এবং ভায়া উভয়ভাবেই থাকে। কন্টাক্ট না থাকলে দালালরা মেয়েদের কীভাবে পতিতালয়তে বিক্রি করে, এবং পতিতালয়গুলোই বা মেয়ে পায় কোথায়?
সূতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত যে, দেশের নারী পাচার হওয়ার প্রধান কারণ-ই হচ্ছে দেহ ব্যবসা বা পতিতালয়গুলো। যেসব মেয়েরা পতিতালয়ের এই অভিশপ্ত পেশায় জড়িত তারা প্রত্যেকেই তাদের অনিচ্ছায় এখানে আছে।
তাহলে হিসাব সোজা। এসব দেহ ব্যবসা ও পতিতালয় বন্ধ করে দিলেই নারী পাচার বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ যেই লোভে পাচারচক্র মেয়েদের পাচার করে থাকে তাদের সেই লোভ মিটিয়ে থাকে পতিতালয়ের মাসী-পিসীরা। তাহলে পতিতালয়-ই যদি না থাকে তাহলে মেয়েদের পাচার করে নিবে কোথায়? অর্থাৎ পতিতালয় নিষিদ্ধ করা হলে ৯৯% নারী পাচার বন্ধ হয়ে যাবে।
কিন্তু দেশের এক শ্রেণীর অসৎ লোক ও দেশী-বিদেশী এনজিও যাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে- নারী অধিকারের নামে নারীদের অধিকারহীন করা, স্বাভাবিক জীবন থেকে যৌনকর্মী তৈরি রূপে করা এবং সমাজে ফেতনা ও অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো, তারা গণিকালয় এবং যৌনকর্মীদের অধিকারের নামে অন্ধকার জগতের এসব অমানবিক, অসামাজিক, অশ্লীল ও নারী নিপীড়নমূলক কর্মকা- টিকিয়ে রাখতে মরিয়া। তারা কিছু পতিতালয়ের মাসী-পিসীদের কিছু টাকা খাইয়ে যৌনকর্মীদের মাঠে নামাচ্ছে পতিতালয়গুলো টিকিয়ে রাখতে। যৌনকর্মীরাও বুঝে না বুঝে এনজিওগুলো দ্বারা প্রতারিত হয়ে সুন্দর স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমন-ই একটা ঘটনা ঘটেছিল ২০০০ সালে।
২০০০ সালে টান বাজার-নিমতলী পতিতালয় উচ্ছেদের কারণে ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা ও অন্যান্য কয়েকটা এনজিও হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করে। এই রিট পিটিশনের মাধ্যমেই হাইকোর্টের রায়ে পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করা হয় যে, যৌনকর্মীকে অন্তত ১৮ বছর বয়স হতে হবে, এবং জীবন ধারণের জন্য এই পেশা বাদে যদি অন্য পেশা না থাকে।
এদিকে গত ১৪ নভেম্বর ২০১৮ পতিতালয় বন্ধে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র সচিব, সমাজ কল্যাণ সচিব ও পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ওমর শরী অ্যাডভোকেট ওমর শরীফ জানান, দেশের সকল পতিতালয় বন্ধ করার জন্য এবং যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক পতিতালয় রয়েছে। সেখানে কাজের কথা বলে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তরুণী, বিধবাদের পাচার করছে। তাই পতিতালয় উচ্ছেদ এবং যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের নির্দেশনা চেয়ে আইনজীবী সোহেল ইসলাম খান এবং শফিকুল কাজল রিট করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেন আদালত। (সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ১৫ নভেম্বর, ২০১৮) (চলবে)
-মুহম্মদ জিয়াউল হক্ব আকন্দ।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
প্রসঙ্গ মহিলা জামাত নাজায়িজ
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
শৈশবকাল থেকেই সন্তানকে দ্বীনদার হওয়ার শিক্ষা দান করতে হবে
২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
সম্মানিতা মহিলা আউলিয়া-ই কিরাম উনাদের পরিচিতি
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
স্বচক্ষে দেখা কিছু কথা
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
পারিবারিক তা’লীমের গুরুত্ব ও তারতীব
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
সুন্নতী খাবার সম্পর্কিত হাদীছ শরীফ : মেথি
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
খাবার বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
জন্মের প্রথম মাস
১৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের অনুসরণে মু’মীনদের জীবন গড়ে তোলা দায়িত্ব-কর্তব্য
১৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
হযরত উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের বেমেছাল দানশীলতা মুবারক (৩)
১৬ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
নারীবাদী বলে কথা........
১৫ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার)