নারীবাদ বা নারীবাদী কি কোনো কাঙ্খিত বা স্বীকৃত শব্দ হতে পারে? তথাকথিত নারীবাদীরা কী মানুষ হিসেবে গণ্য হতে চায় না? (২য় পর্ব)
, ০৬ শাওওয়াল শরীফ, ১৪৪৪ হিজরী সন, ২৭ হাদি ‘আশির, ১৩৯০ শামসী সন , ২৭ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রি:, ১৪ বৈশাখ, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) মহিলাদের পাতা
(গত ২১ রমাদ্বান শরীফের পর)
পাশ্চাত্যে সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে নারীরা যখন সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে, তখন তাদের মধ্যে পুরুষবিদ্বেষ বেড়েছে, সর্বত্র সমানাধিকারের জন্য সোচ্চার হচ্ছে তারা। সহজ যোগাযোগের পথ ধরে সেই ঢেউ প্রাচ্য সমাজেও উত্তাল আলোড়ন সৃষ্টি করছে। নারী যে কিছুই না- এ ধারণা খ্রিস্টীয় চার্চের এবং চার্চের ধারণা এমন যে, “শয়তান সম্ভবত নারীর রূপ ধরে আসে।” হিন্দু সমাজে নারীর জীবনমূল্য অতি তুচ্ছ। পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে নারীর অবস্থান অতীব উচ্চে এবং মহিমান্বিতরূপেই মুসলিম নারীরা ধর্মের কাছে সম্মানিত। যে সমাজে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের বিধি-বিধান পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয়নি, সে সমাজে নারীর সঠিক মূল্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেমন গণতান্ত্রিক সমাজে-পরিবেশে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত নেই। গণতান্ত্রিক পরিবেশে সেই সঙ্গে গ্রাম-সমাজে দারিদ্র্য ও অশিক্ষার জন্য নারীদের প্রতি অবিচারের মাত্রাও বেড়ে গেছে। ফলে গণতান্ত্রিক সমাজের কথিত শিক্ষিত নারীরা নির্যাতিতা ও অসহায় নারীর মুক্তির জন্য কথিত সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিয়েছে এবং সেটাই বর্তমান গণতান্ত্রিক সমাজ-পরিবেশে কথিত ‘উদার নারীবাদী’ চেতনা প্রবাহের সৃষ্টি করেছে। আমাদেরকে সর্বোতভাবে মনে রাখতে হবে যে, এদেশের মানুষের পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতি যত অনুরাগ বা আবেগ থাকুক না কেন, সমাজ কিন্তু ইসলামিক নয়; বরং গণতান্ত্রিক। বিয়ে, তালাক, সম্পত্তিবণ্টন কিংবা অভিভাকত্ব আইনের কাঠামো প্রণয়নে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার অনুশাসন কিছু কিছু মেনে চলার অর্থ এই নয় যে- এটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ। কারণ এখানকার মানুষের কিছু কিছু জরুরী কাজে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার বিধি-বিধানের চর্চা আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু পুরো মানসিকতাই ইসলামবিরোধী। এখানে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজব্যবস্থা কায়িম হতো, যদি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেমনটি পবিত্র মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদিনা শরীফ-এ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তা পুরোপুরি অনুসরণ-অনুকরণ করা হলে। তাহলে আজ এখানে নারী ও পুরুষের লিঙ্গনির্ভর বৈষম্য নিয়ে কথিত নারীবাদীদের প্রতিবাদী হয়ে উঠার প্রয়োজন পড়তো না। সততার সঙ্গে একটি নারী যদি বলতে পারে- সে সমাজে নির্যাতিতা, তাহলে বলতে হবে- সেটা আদৌ ইসলামী সমাজ নয়।
নারীবাদী লেখকদের বক্তব্য এটাই যে, পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা শোষিত হচ্ছে। সেসব শোষণের জায়গাগুলোও নারীবাদী লেখকরা চিহ্নিত করেছে। তাহলো:- বিবাহ আইন- যা নারীকে পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তিতে পরিণত করে; সম্পত্তি বণ্টনের উত্তরাধিকার আইন- যেখানে নারীবাদীরা নারীকে বঞ্চিত বলে মনে করে। নাউযুবিল্লাহ! তালাক- যা স্বামীর ইচ্ছাধীন রাখা হয়েছে, যদিও স্বামীর মারাত্মক ত্রুটির জন্য স্ত্রী স্বেচ্ছায় স্বামীকে ছেড়ে যেতে পারে, তবুও প্রচলিত তালাক বিধানে নারীবাদীরা খুশি নয়। নাউযুবিল্লাহ! সন্তানের মালিকানা প্রশ্নে- নারীর শরীর থেকে যে সন্তান বের হয়, নারী সেই সন্তানের দাবি করতে পারে না, এটা নারীবাদীদের বিবেচনায় অমানবিক। নাউযুবিল্লাহ! সর্বোপরি নারীবাদীরা জরায়ুর স্বাধীনতা চাওয়ারও পক্ষে। নাউযুবিল্লাহ! নারীবাদীদের বক্তব্যে এটাও স্পষ্ট যে- নারী যতই অর্থনৈতিকভাবে সফল হোক না কেন, বাংলাদেশের সমাজে এটি কোনো স্বীকৃত পরিচয় নয়। নারীবাদীদের আলোচনায় এটাও এসেছে যে- বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে বিয়ের মাধ্যমে পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর দ্বারা নারীর একান্তবাস সংক্রান্ত পবিত্রতা নিশ্চিত হয় বটে, তবে নারী স্বাভাবিকভাবে পুরুষের নীতি আদর্শের খাচায় বন্দি হয়ে পড়ে। নাউযুবিল্লাহ!
তবে নারীবাদীরা এটাও বুঝতে পারছে যে- মুনাফাকেন্দ্রিক বাজার অর্থনীতিতে নারী উৎপাদন সহযোগী হিসেবে সবচেয়ে সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে। এ কারণে নারীবাদীদের বক্তব্য হলো- নারীর শ্রমকে অবমূল্যায়ন করার ফলে নারীরা পুরুষের অধীনে নিষ্পেষিত, মর্যাদাহীন। নারীবাদীরা উদাহরণ পেশ করে বলে যে- নারী কিভাবে পুরুষের পর্যায়ে রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করবে? যেহেতু বেতনবৃদ্ধি, কাজের অবস্থান বদল, বাচ্চা রাখার স্থান, ছুটি, ওভার টাইম, সুবিধাজনক রোস্টার, কর্মস্থলে নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে অফিসের আলোচনা সভার আলোচ্যসূচিতে নারীরা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে না। নারীবাদীদের দাবি- রাষ্ট্র যদি নারীর জীবনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক অঙ্গণে নারীর অবাধ বিচরণের অধিকার দিতে হবে (নাউযুবিল্লাহ); যদি তা না হয়, তাহলে সেটা কি রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীকে নিগৃহীত করা নয়?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নারীবাদীদের এ উগ্র মেজাজটা এসেছে এলিজাবেথ কেডি স্ট্যানটনের বক্তব্যের রেশ ধরে। তার মতে, “নৈতিকতার প্রশ্নে নারীরা পুরুষের উপরে। ব্যক্তি ক্ষেত্রের মূল্যবোধ লালন করায় নারী আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী, উন্নত নৈতিকতার অধিকারী ও সত্য-ন্যায়ের পক্ষপাতী। অন্যদিকে পুরুষ বাইরের জগতে কর্মময় থাকায় অন্যায়, অবিচার ও অসত্যের পথে চলে গেছে। অধিকমাত্রায় স্বার্থপরতা ও চাতুরতা চর্চা করায় রাজনীতিকেও পুরুষ কলুষিত করেছে। শক্তি প্রয়োগের প্রবণতা আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির দরুণ পুরুষের কারণেই দ্বন্দ্ব বিরোধ সংঘর্ষ ও যুদ্ধবিগ্রহ বৃদ্ধি পায় বলে ‘উদার নারীবাদী’গণ মত প্রকাশ করে পুরুষের একচ্ছত্র রাজনৈতিক অধিকারের বিরোধিতা করছে।” পাশ্চাত্যে উচ্ছৃঙ্খল ও মোহগ্রস্ত পুরুষের দ্বারা উপেক্ষিত নারীদের মানসিক সঙ্কট থেকে উচ্চারিত মন্তব্যের ভিত্তিতে এলিজাবেথ কেডির মতো অনেকে পুরুষের জীবন চরিত্রচিন্তাকে প্রত্যক্ষভাবে ঘৃণা করতে উৎসাহিত হচ্ছে। সিমন দ্য বুভোয়ার তার ‘সেকেন্ড সেক্স’ বইয়ে প্রশ্ন তোলে যে- “কেন নারীর স্থান সবসময় পুরুষের তুলনা করে অধস্তন হিসেবে ধরা হয়? রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সার্বিক সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী কেন অদৃশ্য কিংবা প্রান্তিক অথবা সেকেন্ড সেক্স?”
পাশ্চাত্য লেখকদের এসব খোলামেলা বক্তব্যের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে এদেশের অনেক লেখক, নারীর জীবনগাথা এমনভাবে রচনা করতে উদ্যোগী যে- তারা বুভোয়ার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বলে, “কেউ নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না, নারী হিসেবে তৈরি হয়।” পাশ্চাত্যের লাগামহীন বক্তব্যের উৎসাহিত এদেশীয় লেখকদের কারো কারো কলমে এমন বাক্য লেখা হয়, “বিয়ে বেশ্যাবৃত্তির লাইসেন্স।” নাউযুবিল্লাহ! আবার বলা হয়, “নারীরা ঐতিহাসিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর পশু।” নাউযুবিল্লাহ! এসব অপচিন্তাধারা ব্যাপকভাবে সমাজের কথিত সুশীল-শিক্ষিত অনিয়ন্ত্রিত স্তরে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের নৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে। বুভোয়ার প্রশ্ন করেছে- “নারী কেন সেকেন্ড সেক্স বা অধস্তন শ্রেণী?” এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা কি বলবো? যারা গোটা মানবজীবনকে একটা সুন্দর পরিণামের দিকে চালিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিদিনকার দায়িত্ব ও কর্তব্যকে কোনোরূপ আধ্যাত্মিক অঙ্গীকারের প্রকাশ হিসেবে দেখে না, বরং নারীর শ্রমকে বস্তুগত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করে, তাদের কাছে নারী তো নিশ্চয়ই সেকেন্ড সেক্স। কিন্তু আমাদের কাছে (তথা মুসলমানদের কাছে) নারী সেকেন্ড সেক্স বা অধস্তন শ্রেণী নয়, কারণ আমরা (মুসলমানরা) নারীকে পুরুষের পরিপূরক সহযোগী সঙ্গী হিসেবে দেখি; যা একটি কল্যাণকর সমাজের জন্য অতীব জরুরী।
-মুহম্মদ ওয়ালিউর রহমান।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
প্রসঙ্গ মহিলা জামাত নাজায়িজ
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য
২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
শৈশবকাল থেকেই সন্তানকে দ্বীনদার হওয়ার শিক্ষা দান করতে হবে
২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
সম্মানিতা মহিলা আউলিয়া-ই কিরাম উনাদের পরিচিতি
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
স্বচক্ষে দেখা কিছু কথা
১৯ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
পারিবারিক তা’লীমের গুরুত্ব ও তারতীব
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
সুন্নতী খাবার সম্পর্কিত হাদীছ শরীফ : মেথি
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
খাবার বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন
১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
জন্মের প্রথম মাস
১৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের অনুসরণে মু’মীনদের জীবন গড়ে তোলা দায়িত্ব-কর্তব্য
১৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
হযরত উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের বেমেছাল দানশীলতা মুবারক (৩)
১৬ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
নারীবাদী বলে কথা........
১৫ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার)