গোপন করা কিছু ইতিহাস
কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের হিন্দু চাটুকাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের উপরে জুলুমের রাজত্ব কায়েম করে (১)
, ০৯ শাওওয়াল শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ০৯ হাদি আশির, ১৩৯২ শামসী সন , ০৮ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রি:, ২৫ চৈত্র, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) ইতিহাস

অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গোটা মুসলমান সমাজকে নিষ্পেষিত ও নির্মূল করার নীতি গ্রহণ করেছিলো ইংরেজ নৌদস্যুরা। মুসলিম আমলে সকল প্রকার সরকারী চাকরীতে সিংহভাগ ছিল মুসলমানদের। ইংরেজ এদেশের মালিক মোখতার হওয়ার পর ধীরে ধীরে মুসলমানগণ সকল বিভাগের চাকরী থেকে বিতাড়িত হতে লাগলেন। শেষে সরকারের বিঘোষিত নীতিই এই হয়ে দাঁড়ালো যে, কোনও বিভাগে চাকরী খালি হলেই বিজ্ঞাপনে এ কথার বিশেষভাবে উল্লেখ থাকতো যে মুসলমান ব্যতীত অন্য কেউ প্রার্থী হতে পারে। ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত আইন পাশ করে মুসলমান বাদশাহগণ কর্তৃক প্রদত্ত সকলপ্রকার জায়গীর, আয়মা, লাখেরাজ, আলতমগা, মদদে মায়াশ প্রভৃতি ভূ-সম্পদ মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে যায়। একমাত্র বাংলাদেশেই অন্যূন্ত পঞ্চাশ হাজার ও ইনাম কমিশন দ্বারা দাক্ষিণাত্যের বিশ হাজার লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের বহু লক্ষ টাকা আয়ের ওয়াকফকৃত সম্পত্তি সরকার অন্যায়ভাবে নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখে প্রকৃত হকদারকে বঞ্চিত করে। সরকারের এসব দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বহু প্রাচীন মুসলিম পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় এবং বহু খানকা, মাদ্রাসা, মসজিদ প্রভৃতি মুসলিম শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যান্ত আইন দ্বারা মুসলমানদের অধিকার থেকে যাবতীয় জমিদারী, তালুকদারী, ইজারা প্রভৃতি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বন্টন করা হলো। ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলি উৎখাত হয়ে গেলো। বাংলার কৃষকদের মধ্যে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ছিল মুসলমান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হিন্দুরা হলো জমির একচ্ছত্র মালিক। কৃষক কুল হলো তাদের অনুগ্রহ মর্জির উপর একান্ত নির্ভরশীল। তাদের শুধু জমি চাষের অনুমতি রইলো, জমির উপর কোন অধিকার বা স্বত্ব রইলো না। হিন্দুরা প্রজাদের নানাভাবে রক্ত শোষণ করতে লাগলো। জমির উত্তরোত্তর খাজনা বৃদ্ধি, আবহাওয়া, সেলামী, নজরানা, বিভিন্ন প্রকারের কর প্রভৃতির দ্বারা কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমানদের কাছ থেকে দাড়ির ট্যাক্স, মসজিদের ট্যাক্স, মুসলমানী নাম রাখার ট্যাক্স, পূজাপার্বনের ট্যাক্স প্রভৃতি জবরদস্তিমূলকভাবে আদায় করতে লাগলো। যেসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল হাজী শরীয়তুল্লাহ, হযরত তিতুমীর রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখ ব্যক্তিগণ।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষার অঙ্গন থেকেও মুসলমানদেরকে বহু দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। ব্যবসা ও শিল্পবাণিজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। আবদুল মওদূদ বলেন, “দেশীয় কারিগর শ্রেণীকে নির্মমভাবে নিষ্পেষণ করে দেশীয় শিল্পদ্রব্যের উৎপাদনও বন্ধ করে দেয়া হয়। তার দরুন শ্রমজীবীদের জীবিকার পথ একমাত্র ভূমি কর্ষণ ব্যতীত আর কিছুই খোলা রইলো না। আর ব্যবসার ক্ষেত্রে বণিক-রাজের কুঠিরগুলিতে আশ্রয়ে নতুন দালাল শ্রেণীর ব্যবসায়ীও জন্মলাভ করলো বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, মুন্সী, দেওয়ান উপাধিতে। বহির্বাণিজ্যে ও অন্তর্বাণিজ্যে সবদিক দখল করে যে দালাল শ্রেণীর জন্মদান করলো, তারাও হয়ে উঠলো স্বার্থ ভোগের লোভে দেশীয় শিল্প ও কারিগরির প্রতি বিরূপ। এই নতুন আর্থিক বিন্যাসের ফলে যে নতুন ভূ-স্বামী ও দালাল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হলো, তাদের একজনও মুসলমান নয় -মুসলমানদের সে সমাজে প্রবেশাধিকারও ছিলো না এবং এই সম্প্রদায়ই ছিল বিস্তৃত গণবিক্ষোভ বা জাতীয় জাগরণের প্রধান শত্রু।
এ কথা বেন্টিংকও স্বীকার করে গেছে- “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি আছে সত্য, তবে এর দ্বারা জনগণের উপর পূর্ণ কর্তৃত্বশালী বড় একদল ধনী ভূ-স্বামী সম্পদায়ের সৃষ্টি হয়। তার একটি বড় সুবিধা এই যে, যদি ব্যাপক গণবিক্ষোভ বা বিপ্লবের ফলে শাসনকার্যের নির্বিঘœতা ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে এই সম্প্রদায়ই নিজেদের স্বার্থে সর্বদাই ব্রিটিশ শাসন বজায় রাখার জন্যে প্রস্তুত থাকবে”। [সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ (শতাব্দী পরিক্রমা), পৃষ্ঠা ৬২]।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উৎপাদিত বাবু সম্প্রদায়:
বাংলায় ইংরেজরা প্রথমে বনিকের ছদ্মবেশে আগমন করার পর তারা যখন রাজশক্তি নিজের হাতে কুক্ষিগত করে। তারপর তারা মীর জাফরের বংশধরদের নাম মাত্র নবাব হিসেবে সিংহাসনে বসালেও প্রকৃত রাজ ক্ষমতা তথা দেশ পরিচালনা করার ক্ষমতা ইংরেজদের অধীনে থাকতো।
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (East India Company) বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করার পর ইংরেজরা নিজেদের অথনৈতিক ভিত্তি ও রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের নীতি গ্রহণ করে। এই সময় ইংরেজরা ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য বিশেষভাবে মনোযোগী হয়। ভূমি কর আদায়ের জন্য তৈরি করা হয় সূর্যাস্ত আইন। এর প্রথম ধাপে কোম্পানী প্রশাসন একসনা বন্দোবস্ত চালু করে। দ্বিতীয় ধাপে তারা পাঁচসনা বন্দোবস্ত চালু করে। তৃতীয় ধাপে দশসনা বন্দোবস্ত চালু করে। সব শেষ ধাপে ১৭৯৩ সালে দশসনা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে (Permanent Settlement) রুপান্তরিত করা হয়। কোম্পানির প্রশাসক জর্ন শোর John Shore সর্বপ্রথম চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাব উত্থাপন করে। ১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিস (The Marquess Cornwallis) কোম্পানীর গর্ভনর হয়ে আসলে সে সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয়। কোম্পানী প্রশাসন মুলত বহুমুখী উদ্দেশ্যে এই ভূমি ব্যবস্থা প্রনয়ন করে। এই ব্যবস্থার প্রবর্তক কর্নওয়ালিস বলে যে, “আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই (এ দেশের) ভূ-স্বামীগণকে আমাদের সহযোগী করিয়া লইতে হইবে। যে ভূ-স্বামী একটি লাভজনক ভূ-সম্পত্তি নিশ্চিত মনে ও সুখে শান্তিতে ভোগ করিতে পারে তাহার মনে উহার কোনরুপ পরিবর্তনের ইচ্ছা জাগিতেই পারে না” (ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন, লেখক বদরুদ্দীন উমর পৃষ্টা ১৪)
রাজ্য বিস্তার ও আগ্রাসন:
অপরদিকে ইংরেজরা বাংলা বিহার উড়িষ্যার থেকেই ভূরাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে তাদের রাজ্য বিস্তারের যে পরিকল্পনা করছিলো। তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিকা ছিল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় কোম্পানীর বিপুল ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আগ্রাসন চালাতে যে পরিমান অর্থ ব্যয় তা মুলত বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজস্ব থেকেই নির্বাহ করা হয়েছিল। এমনকি ১৮৫৮ সালে মহাবিদ্রোহের পর ভিক্টোরিয়া যে কোম্পানী শাসন অবসান করেছিলো তখন সে কোম্পানীকে যেটি ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলো সেটি সে ভারতের রাজস্ব হতেই দিয়েছিলো। (অসমাপ্ত)
-মুহম্মদ মুশফিকুর রহিম।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কাফিরদের রচিত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মুসলমানদের জন্য নয় (১)
২৭ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ০৬)
২৬ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
বেনিয়া ব্রিটিশ দখলদারিত্ব বিশ্বব্যাপী অগণিত যুদ্ধাপরাধ, জুলুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত
২৫ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
বিধর্মীরা নিজেদের স্বজাতির কারো আঘাতেরও পাল্টা প্রতিশোধ নিতে ভুলে না, কিন্তু মুসলমানরা বিধর্মীদের কাঁটার বদলে ফুল দেয়
২৩ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (১৬)
২২ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ০৫)
২২ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ০৪)
২১ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (১৫)
১৯ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ০৩)
১৭ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ০২)
১৬ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ০১)
১৫ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
বিশ্বব্যাপী ইহুদী ষড়যন্ত্রের মাস্টার প্ল্যান প্রটোকল অফ ইহুদী
১১ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার)